মো. হারুন অর রশীদ
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে আগরতলার নাম। বিশেষ করে আগতলা ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কৌশলগত কারণে পাকিস্তান আমলে মামলাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করার প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখন সময় এসেছে সত্য প্রকাশ করার এবং সেই সময়ে যারা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আগরতলায় বসে চেতনার সিড়ি রচনা করেছিলেন তাদের অবদানকে স্বীকার করার। এ প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগে একটি অনুষ্ঠানে তৎকালীন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী আগরতলা মামলাকে একটি ঐতিহাসিক এবং সত্য মামলা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ঐতিহাসিক কারণে এটির প্রয়োজন ছিল এবং প্রয়োজনের তাগিদেই জীবন বাজী রেখে এ ঘটনা ঘটানো হয়। এটা কোন মিথ্যা মামলা ছিল না। এ ঘটনা ঘটানোর একটিই উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা। ঘটনার পরিসমাপ্তিও হয়েছে সেপথেই। সুতরাং আগরতলা মামলা জাতির ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অংশ।
আমাদের সময় ডট কমে ১৮ আগস্ট ২০১৫-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে,‘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জনযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লে: কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মুক্ত করার পরিকল্পনা ধরা পড়ে যায়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু, মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অন্যান্যের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের শুনানি। এ সময়েই তিনি জনযুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন সামরিক যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ আর স্বাধীন করা করা সম্ভব নয়। জনযুদ্ধই একমাত্র পথ। এবং সেভাবেই তিনি পরিবেশটা তৈরি করেছিলেন।
শওকত আলী তার আলোচনায় বলেন, ’রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ (যা পরিবর্তিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতি পেয়েছিল) মামলার শুনানি চলছিল। মামলাটি শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ শে জুন। এ বিচার সম্পন্ন করার জন্য গঠিত হয়েছিল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। শুনানির সময়ে শেখ মুজিবর রহমান কর্নেল শওকত আলীকে একদিন সামনে পেয়ে বলেন, ‘কি শওকত এবার ধরা পড়ে গেলে। এরপর কি করবা?’ কর্নেল (অব.) শওকত আলী কিছু বলার আগেই বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ’এবার একটি নির্বাচন করবো। নির্বাচনে জনগণ আমাদের রায় দেবে। এ রায় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী মেনে নেবে না। তারপরই হবে জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে স্বাধীন করবো।’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে গঠিত বিশেষ ট্রাইবুনালে শুনানি চলছিল। শুনানিতে মামলার চিফ প্রসিকিউটর ছিলেন মঞ্জুর কাদের। এই মঞ্জুর কাদের ছিলেন আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরবর্তিতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। মঞ্জুর কাদেরকে পাকিস্তান সরকার আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান প্রসিকিউটর হিসাবে নিয়োগ দেয়। ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বসা ছিলেন। সে সময় শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে আইনজীবি যুক্ততর্ক উপস্থাপন করছিলেন। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তখন কাঁদছিলেন। এক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি প্রধান প্রসিকিউটর মঞ্জুর কাদেরকে উদ্দেশ্য করে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘কথা শুনেছো। আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব।’
শেখ মুজিবর রহমান হাউ-মাউ করে কাঁদছিলেন। আমরাও কাঁদছিলাম। শওকত আলীর ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে আমি কোন দিন কাঁদতে দেখিনি। তারপর কঠিন হয়ে মঞ্জুর কাদেরকে উদ্দেশ্যে এ কথা বলে ওঠেন তিনি। এই মামলার এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবর রহমান। শেখ মুজিবর রহমানের হুঙ্কারে হতভম্ভ হয়ে পড়েন তিন বিচারক। তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না এখন তাদের কি বলা উচিত। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের বিচারে গঠিত ট্রাইবুনালকে মোকাবেলা করার জন্য কৌশল ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধের পথকে সুগম করা। শুনানির আগে সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের বিরদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করা। যাতে বিচারকার্য দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল বেশি। শওকত আলী বলেন, অভিযোগ অস্বীকার পেছনে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য ছিল এটাই, দোষ স্বীকার করলে তাড়াতাড়ি রায় হয়ে যাবে। স্বীকার না করলে মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে চলবে। এর ফলে জনগণ সংগঠিত হবে। পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। জনমত তৈরি হবে। আর একটি নির্বাচনের পথ তৈরি হবে। যেখানে জনগণ আমাদের পক্ষে রায় দেবে।
শওকত আলী বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথান হয়। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি হয়। এর ফলে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরুঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। অর্জিত হয় বিজয়। যে যুদ্ধের প্রধান শক্তি ছিল গণমানুষ। । আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন তারই প্রতিফল ঘটে। ’
কানাডা ইউনিট কমান্ডের অন্যতম নির্বাহী ও বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টা এর সভাপতিদেলোয়ার জাহিদের ভাষায়,‘ উনসত্তুরে গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আমাদের বেলাবো উপজেলার গ্রামের বাড়ীতে এসেছিলেন । আমার জ্যেঠা আবদুস সোবহান পন্ডিত মওলানা ভাসানী এর একজন খুবই ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।। স্ব-শিক্ষিত ভাসানী, ঔপনিবেশিক রীতিনীতির প্রতি যেমন ছিলেন চরম আস্থাহীন। তেমনি আমার জ্যেঠা মহাশয় ও ছিলেন তাই. উনসত্তুরে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে মওলানা ছিলেন আমাদের অণুপ্রেরনার উৎস্য। জ্যেঠার বাংলা ঘরে ঢুকেই হেসে উঠেছিলেন মওলানা ভাসানীৃকারন আর কিছু নয়, প্রথমেই তার নজরে এসেছিলো বেড়ায় ঝুলানো শেখ মুজিবের একটি ছবি।
ক্ষমতাবিমুখ ভাসানী গ্রাম ভিত্তিক, উগ্র মতবাদে উজ্জিবিত করেছিলেন ছাত্র, কৃষক শ্রমিক ও জনসাধারণকে, যাদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি আগরতলা (ষড়যন্ত্র!)মামলা বাতিল, এবং জেলের তালা ভেঙ্গে শেখ মুজিবকে বের করে আনার আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে ছিলেন।
পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলা (ষড়যন্ত্র!) মামলা রুজু করে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কে প্রধান আসামি করে জেলে ঢুকিয়ে ছিলো। তার সংগে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদেরও এ মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। তাদের বিরুদ্ধে মূলতঃ যে অভিযোগ ছিল:
ভারত সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা শহরে ভারতীয় পক্ষ ও আসামি পক্ষদের মধ্যে এ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে অত্র মামলায় উল্লেখ করা হয় যার জন্য একে আগরতলা (ষড়যন্ত্র!) মামলা বলা হয়।
পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার বাঙালিকে এ মামলায় গ্রেফতার করে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেসনোটে জানায়, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ প্রেসনোটে ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ৮ জনের গ্রেফতারের খবর প্রকাশ পায়। স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি অপর এক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ মামলা ও এর প্রতিক্রিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলাটি প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।
এ মামলায় অভিযুক্ত যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয় তারা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সিডিআই নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউল্লাহ, প্রাক্তন কর্পোরাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আব দুর রাজ্জাক, প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, মো. খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান সিএসপি, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম এএমসি, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এ.এন.এম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লে. এস.এম.এম রহমান, প্রাক্তন সুবেদার এ.কে.এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এএমসি এবং লে. আবদুর রউফ।
সার্জেন্ট আবদুল জলিল, (আগরতলা (ষড়যন্ত্র!)মামলার ২৯ নং অভিযোক্ত ছিলেন আমার জ্যেঠাতো ভাই। যিনি একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাথে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে ছিলেন। এসব কারনে আমার বাবা কবি এম. এ খালেক ও বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভৈরবে শহীদ নুরু আতিকের জীবনদানের জন্য আমার মাতৃকুল, ও আগরতলা (ষড়যন্ত্র!)মামলায় সহঅভিযুক্ত হবার কারনে পিতৃকুলের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
আগরতলা (ষড়যন্ত্র!)মামলার বিষয়ে ইতিহাস বিস্মৃতিই আমাদের স্বাধীনতার মূল জাতীয় ইতিহাসকে ভিন্ন পথে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আজো এ মামলা ষড়যন্ত্র! মামলা হিসেবেই পরিচিত। যা হবার কথা নয় বা ছিলো না। এ মামলাটি স্বাধীনতার একটি পরিকল্পনা! মামলা. স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে এর সফলতা এসেছে।’ (সূত্র: বিডিনিউজ২৪.ব্লগ. ২৬ জুন,২০১৬)
আর কে চৌধুরী লিখেছেন,‘ভারতীয় সীমান্ত রাজধানীগুলোর মধ্যে একমাত্র আগরতলাই বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন। আর এই ভৌগোলিক যোগসূত্রের কারণে আগরতলা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে মুখ্য বন্ধুর ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। সরকার গঠনের পর থেকেই মুক্তি সংগ্রামের কাঠামোগত বিন্যাস তৈরি হয়ে যায় এবং বিভিন্ন শরণার্থী শিবির, ইয়ুথ ক্যাম্প এমএনএ ও এমপিদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। বাঁধ ভাঙা প্লাবনের মতো দেশত্যাগী মানুষ এখন ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রবেশ করছে তখন একদিকে শরণার্থী পুনর্বাসনের কাজ অন্যদিকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ আর ট্রেনিং দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুক্তিকামী হাজার হাজার তরুণ-যুবকের সমন্বয়ে মুক্তিফৌজ গড়ে তোলার কাজ। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ভারতের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চিরস্মরণীয়। শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার এসেছিলেন আগরতলায়। নয়াদিল্লী থেকেই আমি সব খবর পাচ্ছি। আমি এসেছি এই অসহায় ও অত্যাচারিত মানুষদের সহানুভূতি জানাতে। ১৬ জুলাই ত্রিপুরার উপমন্ত্রী মনসুর আলী বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। জুলাই মাসের ভেতরে সারা ভারতে ৫৭ লক্ষ ৬৩ হাজার শরণার্থী ঢুকে পড়ে। ত্রিপুরায় আগত শরণার্থীদের সমস্যা ও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা ছিল নিম্নরূপ : স্থায়ী লোকসংখ্যা : ১৫৫৯০০০ জন আগত শরণার্থী : ১২২১০৭৫৪ জন। শিবির সংখ্যা : ৩৬টি। ইউনিট : ৩৮২টি। শিবিরবাসী : ৬৯২১৫৫ জন। ব্যক্তিগত ব্যবস্থা : ১৫০০০০ জন। আত্মীয়ের সঙ্গে : ৩৮৯৬০০ জন। রাজ্যের বাইরে প্রেরিত : ২৫৪৪০ জন। সংরক্ষিত ব্যবস্থা : ৭৫০০০ জন। এ পর্যন্ত ব্যয় : ৭২০০০০০০ টাকা। সম্ভাব্য ব্যয় : ৪৫ কোটি টাকা। চিকিৎসা : ৩৫০ জন ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মী।
শরণার্থীদের এই রকম জোয়ারের মুখে ত্রিপুরার খাদ্যদ্রব্য আর ভোগ্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। ডিমের হালি তিন টাকা ১২ টাকায়। শুধু আগতলা নয় মহানগরী কলকাতাও এই সময় বিপর্যস্ত হয়েছিল বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যার ভারে। আগস্ট মাস নাগাদ পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী ঢুকেছিল ৫২ লক্ষ ৭২ হাজারের বেশি। আগস্ট মাস থেকে যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত রাতের বেলায় কার্ফু জারি থাকতো আগতলায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা এলে ইন্দিরা গান্ধীর কথা তোলা কেবল স্বাভাবিক নয়, অত্যাবশ্যকীয়ও। ৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী এক জনসমাবেশে পরিষ্কার ভাষায় বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) শরণার্থীরা যারা এখানে এসেছে তারা এখানে নিমন্ত্রণ খেতে আসেনি। তারা আক্রান্ত, বিপন্ন। বিশ্বের কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রই আজ পর্যন্ত এতো বিরাট সংখ্যক শরণার্থীর দায় নেয়নি। ভারতেও সে ক্ষমতা নেই। কিন্তু ভারত তার মানবিক দায়িত্ব ও দায় থেকে চ্যুত হতে পারে না বা কারো ভয়ে ভীত হয়ে সে দায়িত্ব পালনে বিরত হবে না।' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাকে মুক্ত পৃথিবীর মুখ্য প্রতিনিধি বলে চিহ্নিত করা হয়, সেই যুক্তরাষ্ট্রের সেদিনকার সরকার বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে ছিল না। গণচীন, ছিল না বেশ কিছু আরব রাষ্ট্রও। বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামে আমেরিকানদের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা তাকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আর স্বাধীন সংবাদপত্র তাদের ভূমিকা শরণীয় 'ওয়াশিংটন' পোস্ট', 'নিউইয়র্ক টাইমস', 'টাইম' ও নিউজিইউক' ইত্যাদি সংবাদপত্র; ব্রিটেনের 'গার্ডিয়ান', 'লন্ডন টাইমস' এবং টেলিগ্রাফ জোরালো ভূমিকা রেখেছিল পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে। এসেছিলেন মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি কলকাতা ও আগরতলায়। ১২ আগস্ট কেনেডি ত্রিপুরা রাজ্যে। বিমানবন্দর থেকে রাজনিবাসের দু'ধারে বিপুল জনতা। সেদিনকার সেই অবিশ্বাস্য ভিড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের শরণার্থী আর ত্রিপুরাবাসী। সেস্নাগান উঠেছেথ 'এডওয়ার্ড কেনেডি জিন্দাবাদ' 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিন্দাবাদ'। বিমানবন্দর থেকে জে.বি হাসপাতাল, সেখান থেকে সার্কিট হাউস। কেনেডি এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নয় এসেছিলেন শরণার্থী সংক্রান্ত সিনেট সাব-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক প্রতিনিধিরা যেদিন আগরতলায়, সেদিন অকস্মাৎ কামানোর গোলা পড়তে থাকে ত্রিপুরার মাটিতে। মিস্টপার জিন্নাহর-দ্বি-জাতি তত্ত্ব এবং অবৈজ্ঞানিক ভৌগোলিক বিভাজনে পাকিস্তানের সৃষ্টি বাস্তবের রূঢ় সংঘাতে আজ অসার বলেই প্রমাণিত। জনক্রিস এক সময় 'হাউস অব লর্ডস'-এর সদস্য ছিলেন। লর্ডশিপ ত্যাগ করে ঢুকেছিলেন তিনি সাংবাদিকতায়। অক্টোবর মোহনপুর ও মধুপুর শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকারে জনৈক কিশোর এবং গ্রামের একজন সরল বধূ তাদের পরিবারের ওপর পাক সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের কাহিনী তাকে যখন শোনাচ্ছিল, তখন সেই বিদেশির পক্ষেও তার চোখের পানি স্মরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের এককালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সরকারি ও শরণার্থীদের মনোবল দৃঢ় করার জন্য হাপানিয়া শিবিরে তিনি বলেন, স্বাধীনতা লাভের জন্য যে দুর্বার সংগ্রাম আজ বাংলাদেশে শুরু হয়েছে অদূর ভবিষ্যতে তার পূর্ণ সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ত্রাণ কমিটি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় জয়প্রকাশ নারায়ণপুর ঘুরে গেছেন আগরতলা ও ত্রিপুরার শিবিরগুলো। স্বচক্ষে দেখে গেছেন কতোটুকু নির্যাতিত আর বর্বরোচিত হামলা হলে মানুষ নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ৫ অক্টোবর হাপানিয়া শরণার্থী শিবিরের দেশত্যাগীদের সাথে দেখা করে সেখানে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, শিবিরের অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকার যা করছে তা অপ্রতুল হলেও সারা ভারতের আন্তরিকতা এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে। ভারত সরকারের হয়ে আমি কোনো কথা বরার অধিকার না থাকলেও ভারতবাসী হিসেবে আমি দৃঢ় প্রত্যয়ে এই কথা বলতে পারি, প্রত্যেক ভারতবাসীই আজ বাংলার মুক্তিযুদ্ধের সাথে মনেপ্রাণে যুক্ত হয়ে গেছে। আর এ জন্য যতো বড়ো ঝুঁকিই নিতে হোক না কেন তার জন্য সারা ভারতের মানুষ মানসিকতাভাবে প্রস্তুত। পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে। ভৌগোলিক কারণেই ১ থেকে ৪ নম্বর সেক্টরের সীমানা ক্ষুদ্র ভারতীয রাজ্য ত্রিপুরার সাথে গাঁথা ছিল। সিলেটের সুনামগঞ্জ-ডাউকি-বাঁশতলা-জৈন্তাপুর ইত্যাদি নিয়ে যে ৫ নম্বর সেক্টর তাও এক অর্থে ত্রিপুরা সীমান্তঘেঁষা। অন্যদিকে ১০ নম্বর সেক্টর তৎপরতার দিকে থেকে যুক্ত ছিল ত্রিপুরার সাথে। ২৫ মার্চ। রাত তখন প্রায় একটা। ছাড়া-শ্যামলিয়া ঘেরা পাহাড়-পরিবৃত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ঘুমে নিমগ্ন। বীর প্রসবিনী চট্টলার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের ছাউনিতেও ঘুম তখন তার আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। ২০নং বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্য বোঝাই ছয়টি ট্রাক এসে ধীরে ধীরে রেজিমেন্ট সেন্টারের অস্ত্রাগারের সামনে দাঁড়ালো। অস্ত্র পদক্ষেপে অস্ত্রে সজ্জিত সৈনিকরা ট্রাক থেকে নেমে পড়লো। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা অস্ত্রাগার আধিপত্য বিস্তার করলো। অস্ত্রাগারে প্রহরারত রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা আক্রমণে প্রাণ হারালো। প্রহরারত বাঙালি সৈনিকদের নির্মমভাবে খতম করে দিয়ে পশ্চিমা দস্যুরা সেন্টারের চতুর্দিকে পজিশন দিয়ে করলো শুরু হলো তাদের পৈশাকি হত্যাযজ্ঞ। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারে মেজর জিয়ার নিজের তরফ থেকে এবং পরে শুদ্ধ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন, সেটা আজ আমাদের জানা ইতিহাসের বিশেষ অংশ। সেদিন ঐ ঘোষণা বৈদাৎ ধ্বনি হলেও ইতিহাসের শ্বাশত নিয়মেই সেই মেজরটি আর দশজন সাধারণ মেজর বা অন্যসব সেক্টর কমান্ডারের মতো থাকেননি। আসাম-মেঘালয় সীমান্ত বরাবর 'জেড ফোর্স' আর তেলঢালা ক্যাম্পে মেজর। তবে যে পরিস্থিতিতে যে পদ্ধতিতেই ভাষণটি প্রচারিত হোক না কেন, সেটা প্রায় সারাদেশের মানুষের কানে পৌঁছেছিল এবং জাতির গভীর হতাশার ভেতরে সঞ্চার করেছিল নতুন আশা ও উদ্দীপনার। স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বিতর্কে, আমার মনে হয়, রাজনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ অংশগ্রহণ করবেন না। কারণ একটি দেশের বা জাতির মুক্তিযুদ্ধ কেবল একজন মেজরের বেতার ভাষণে পরিচালিত বা সম্পন্ন হয়নি। যারা এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করছেন এখনো তারা পরোক্ষভাবে নিজেদের 'নব্য হিরো' বানাবার অপচেষ্টা করেছেন। কেবল একটি ঘোষণার ভেতর দিয়েই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, সুদীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জাতির সংগ্রামী হূদয় তৈরি হয়নি। ১ নম্বর সেক্টরের লগোয়া ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন প্রথমে মেজর খালেদ মোশাররফ, পরবর্তীকারে মেজর দুর্র্ধষ গেরিলা কমান্ডার এটিএম হায়দার (এদের দু'জনই ৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত)। এই গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটি গড়ে উঠেছিল কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও শরীয়তপুরের কিছু অংশ এবং মুন্সীগঞ্জ এলাকা নিয়ে। রাজধানী ঢাকার 'অপারেশন' থেকে শুরু করে এর শহরতলীতে পর্যন্ত পাকিস্তানিদের জন্য ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই সেক্টরের দুঃসাহসী গেরিলারা। মেলাঘর, গঙ্গাসাগর, কসবা, শালদা নদী, বেলোলিয়া ও চৌদ্দগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিসেনারা। তারা আহত ও নিহত হয় এবং শত্রুসেনাদের পর্যুদস্ত করে। ৩ নম্বর সেক্টরের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলাগাছিয়া, আখাউড়া, পরুলিয়া ও দরুইন ইত্যাদি জায়গা। এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন প্রথমে মেজর কে.এম শফিউল্লাহ ও পরে মেজর এএনএম নূরুজ্জামান। এই সেক্টরের অধীনে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুরসহ টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের কিয়দংশ। ৪ নম্বর সেক্টরে অধিনায়ক ছিলেন মেজর সিআর দত্ত। মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে ছিল ৫ নম্বর। মুক্তিবাহিনীতে ১ নম্বর এবং পরবর্তীকালে জেড ফোর্স' জিয়াউর রহমান ছাড়াও এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন, যাকে জিয়া হত্যাকা-ে অভিযুক্ত করে পরবর্তীকালে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল আমিন আহমদ/ অগণিত দুঃসাহসী যুবক, তরুণ, ছাত্র, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার বা শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেম আর দেশপ্রেমের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। মেজর জিয়া, মেজর রফিক ও অসংখ্য বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, মহালছড়ি হয়ে রামগড়ে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে বিপদঙ্কুল পথ পেরিয়ে চলে আসেন সাব্রুম দিয়ে আগরতলায়। এপ্রিলের ২ তারিখে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে নিজস্ব গাড়ি করে আগরতলায় প্রবেশ করেন আওয়ামী লীগ নেতা সর্বজনাব আব্দুল মালেক উকিল, মিজানুর রহমান চৌধুরী চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মান্না, আব্দুল হান্নান, এম আর সিদ্দিকী, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খোন্দকার মুস্তাক আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রমুখ প্রথম কাতারের নেতা যার যার সুবিধাজনক গোপন পথে পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করেন।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্ররাল সিংহের সাথে পর্যায়ক্রমে কথাবার্তা হয় নেতৃবৃন্দের। শচীন্দ্রলাল সিংহ, এমএনএ এডভোকেট সিরাজুল হক এবং এমএনএ এমআর সিদ্দিকী নিয়ে তিনি চলে গেলেন নয়াদিল্লী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনার উদ্দেশে। ভারত শিক্ষামন্ত্রী ড. ত্রিগুনা সেন এই পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলাম ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করে গেছেন। তিনি রামগড় থেকে সাব্রুমে এসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১২ এপ্রিল আগরতলা সার্কিট হাউসে অত্যন্ত সংগোপনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জহুর আহমদ চৌধুরী নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক সভা বসে। এই সভাতেই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকার। এই গোপন সভারই চারদিন পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সরকারের ঘোষণা দেয়া হয়। ভারতের মাটিতে না হয়ে বাংলাদেশের যে কোনো মুক্তাঞ্চলে ঘোষণাটি যে হওয়া ছিল বাঞ্ছনীয়। ১২ এপ্রিল আগতলায় স্বাধীন বাংলার সরকার গঠনের কাজ সর্বসম্মতভাবে সমাধা করেও মেহেরপুরের মুক্তাঙ্গলে তা ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আগতলায় স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের খবরটি শুধু সারা ভারতের সংবাদপত্রের নয়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচারিত হয়। ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ-এ ১৩ এপ্রিলের ব্যানার হেডলাইটটি ছিল এ রকমের। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে রক্ত ও অগ্নিশুদ্ধ স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষিত' তাজউদ্দিন আহমদের প্রধানমন্ত্রীত্ব স্বাধীন বাংলার মন্ত্রিসভা। কুষ্টিয়ায় সদর দফতর স্থাপন : স্বাধীন বাংলার বেতারের ঘোষণা : বিশ্বে নজিরবিহীন ইতিহাস রচনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রনায়ক। তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের খসড়াও সম্পূর্ণ। ৮ থিয়েটার রোড, কলকাতা, এই ঠিকানায় অবশেষে স্থাপিত হয় মুজিবনগর সরকারের প্রধান দফতর। আগতলা ছিল এক অর্থে বাংলাদেশের ডেটলাইন। ভারতীয় সাংবাদিকদের ভিড় ছিল আগরতলায় সীমাহীন। অসংখ্য ভারতীয় সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্ট করেছেন আগতলায় এসে। ভারতীয় সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেন। একজনের নাম সুরজিৎ ঘোষাল (আনন্দবাজার) ও অন্যজন দীপক ব্যানার্জি (অমৃত বাজার)। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আগরতলা থেকে ঢাকা ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোর খবরা-খবর সংগ্রহ যতো সহজ ছিল, অন্য কোনো ভারতীয় শহর থেকে ততোটা নয়। আগরতলা সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ডেটলাইন হতে পেরেছিল। ঢাকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নিত্যদিনের গতিবিধি এবং কার্যকলাপ সেদিনই পেয়ে যেতেন আগতলায় বসা সাংবাদিক বন্ধুরা। আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও সন্তোষগুপ্ত অন্্যতম। ১৯৭১-এর ৩১ মার্চ, ভারতীয় সংসদের উভয় সভায় সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের ওপর একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাংলাদেশের সামপ্রতিক ঘটনাবলীতে এই সংসদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ভারতের মাটিতে, বিশেষ ত্রিপুরা সীমান্তে যখন পাকিস্তানিদের অব্যাহত আক্রমণ চলছে, তখন ভারতীয় লোকসভায় ৩০ জুলাই ইন্দিরা সরকার বলেন, যে 'ভারত সীমান্তের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।' সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর এই তিনটি মাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা যেমনি বৃদ্ধি পায়, তেমনি ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে পাকিস্তানিদের তৎপরতাও জোরদার হয়। সিদ্ধার্ধ শঙ্কর রায় যেদিন আগরতলা এলেন, অর্থাৎ ২০ অক্টোবর সেদিন, সংলগ্ন শহর অব্যাহত পাকিস্তানি হামলার ফলে বিরান হয়ে গেছে। বিলোনিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তটি এমনভাবে জড়িত যে, এখানে বোঝাতে কষ্ট হয়, আসলে কোনটা বাংলাদেশের আর কোনটা ত্রিপুরার। ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যা পৌঁনে আটটা নাগাদ পাকিস্তান বাহিনী আচমকা রাজধানী আগরতলার ওপর হালকা কামান থেকে পরপর ছ'টি গোলা নিক্ষেপ কর। ত্রিপুরা সারা সীমান্ত এলাকায় তখন চলছে নিষ্প্রদীপ মহড়া। যে কোনো মুহূর্তে শত্রুপক্ষের বিমান হামলা হতে পরে- এই রকম আশঙ্কায় থরোথরো। ৩ ডিসেম্বর সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং সেদিন থেকেই শুরু হয় যৌথ ভারত-বাংলাদেশ বাহিনীর অভিযান। পূর্বাঞ্চলের সাথে সাথে পশ্চিম রণাঙ্গনেও যুদ্ধের দামামা বেঝে উঠে। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কাতেই অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বরেই আগরতলার ওপর তিনবার বিমান হামলায় চালায় পাকবাহিনী। স্যাবর জেটগুলো
স্যাবর জেটগুলো আগরতলা বিমানবন্দরে এলাকায় রকেট বোমা নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে অমৃতসর, শ্রীনগর ও পাঠানকোট যৌথ বাহিনীর কাছে [লে. জে. জগজিৎ সিং আরোবার নেতৃত্ব] পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বাঞ্চলে যে আঘাতের সম্মুখীন হতে থাকে, সেটা সইবার সামর্থ্য তাদের ছিল না। ৪ ডিসেম্বররই আগরতলা সীমান্ত জোড়া হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটিগুলো যৌথ বাহিনীর আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানি স্থল বাহিনীর আক্রমণ থেকে আগরতলা বিপদমুক্ত হয়। অন্যদিকে একদিন পর পাকবাহিনীর একটি দুর্গের পতন ঘটিয়ে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলে বঙ্গোপসাগর, আখাউড়া, উজানিসার, লাডুমুড়া, ফকিরামুড়া, আজমগড় অভিমুখে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সত্তার প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানায়। লোকসভার স্বল্পকালীন এক অধিবেশনে প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা মুহূর্মুহু করতালির ভেতরে ঘোষণা করেন আসমুদ্র ভারতের কোটি প্রাণের সেই আকাঙ্ক্ষিত বার্তা: 'বাংলাদেশ আজ এক স্বতন্ত্র নতুন রাষ্ট্র। পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতি এক নতুন রাষ্ট্র। পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতি আজ এক নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক।' অন্যদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও বাংলার মুক্তি সংগ্রাম-বিরোধী উদ্যেগের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তৃতীয়বারের মতো 'ভেটো দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলো। ঐ সময় জাতিসংঘে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন শ্রী সমর সেন। ভারতের স্বীকৃতি, সাফল্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আনন্দে আত্মহারা ছাত্র, শ্রমিক, কর্মজীবি, রাজনীতিবিদ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সংসদের পবিত্র চত্বর হতে স্বীকৃত হলো কনিষ্ঠতম রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ইতিহাসের একটি পবিত্র লগ্নে ভারতের পঞ্চান্ন কোটি জনতার প্রতিভূ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে লাঞ্ছিত অপমানিত ও হূতসর্বস্ব সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পৌঁছে দিলেন মানব সভ্যতার বাঞ্ছিত লোকে।' ষড়যন্ত্রের সমস্ত জাল ছিন্ন করে আর শত সহস্র সন্দেহের আবরণ ভেদ করে সবুজ ঘাসের দেশের লাল সূর্যের স্বীকৃতি ঘোষিত হলো রৌদ্রকরোজ্জ্বল দ্বিপ্রহরের এক পূতপবিত্র লগ্নে। ৭ মার্চের বিকেলে রমনার বিশাল উদ্যানে লাখো জনতার উত্তর তরঙ্গধ্বনি যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল, যে শপথ নিয়েছিল বাঙালি জনতা শেখ মুজিবের নেতৃত্ব, তার পরিণতি আজ আট মাসের রক্তঝরা উষ্ণ অমসৃণ পথ বেয়ে পৌঁছুলো তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। ডিসেম্বরের ১/২ তারিখ থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। আগরতলার ওপর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান বহর তখনো ক্রমাগত আঘাতে হেনে চলেছে। অন্যদিকে আখাউড়া রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর হতে অবরুদ্ধ হয় হানাদার বাহিনী। হাসপাতালগুলোর মেঝে ভাবে যায় বিমান হামলায় হতাহতদের রক্তে। কিন্তু তাদের নাগরিক জীবন নিদারণভাবে বিপর্যস্ত হলেও বিন্দুমাত্র মনোবল হারানি আগরতলার মানুষ, তথা ত্রিপুরাবাসী। ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ'র একটি বিবৃতি সারাদিন ধরে ভারতীয় বেতার থেকে প্রচারিত হতে থাকে। বিবৃতিটি ছিল এ রকমের: '১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে পাকিস্তান বাহিনী যদি নিঃশর্তে নিকটস্থ ভারতীয় বাহিনী বা যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসর্পণ ও পূর্ণ অস্ত্র সংবরণ না করে তাহলে তাদের আর কোনো সময় দেয়া হবে না। যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে পাকিস্তানিদের ঘিরে ফেলেছে। গভর্নর মালেক পদত্যাগ করে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের রেডক্রসের আশ্রয়ে চলে যান। ১৬ ডিসেম্বর দুপুর আড়াটায় (ভারতীয় সময়) বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. নিয়াজমার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির আবেদন জানালে জেনারেল মানেকশ ঢাকার ওপর ভারতীয় বিমান হামলা বন্ধের নির্দেশ দেন। পাকবাহিনী বুঝতে পারে তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ছাড়া পথ নেই। যদিও সর্বাধুনিক আণবিক অন্ত্র নিয়ে মার্কিন ৭ম নৌবহর তখন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেছে প্রায় মৃত পাকবাহিনীকে সহায়তা করতে; কিন্তু ভারত মহাসাগরের দিকে দ্রুত ধাবমান হয় তখন রুশ 'বাল্টিক' নৌ-বহরের দুটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ। ওয়াশিংটনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে. এল. ঝা এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেই মুহূর্তে বন্তব্য করেন, 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত আমেরিকান ও বিদেশি নাগরিকদের উদ্ধারের নামে যে কোনো বহিঃরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ভারত অমিত্রসুলভ আচরণ বলে বিবেচনা করবে এবং এই বদ মতলব বরদাশত করা হবে না।' পাকিস্তানি সেনাপতি লে. জে. নিয়াজীকে বলা হয়েছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করতে। তার কাছে খবর পৌঁছানোর জন্যে বিশেষ বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং দেয়া হয়েছে কোড নম্বরও। পাকিস্তানি সৈন্যরা যেভাবে পারছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পীবণ বাচিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে আসছে। অবশেষে মুক্ত হলো রাজধানী ঢাকা। বাঙালির আজন্ম লালিত স্বাধীনতার পবিত্র মুখ হলো উদ্ভাসিত। বর্বর হানাদার বাহিনী হলো নতজানু। বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে উড়তে থাকে বিজয় পতাকা। আবার সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। ৭ মার্চ যে ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় দীর্ষ ২৮২টি কালো রাতের অবসান ঘটিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিংহ আরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে পরাজিত বাহিনীর সেনাপতি লে. জে. নিয়াজী। ফৌজি রীতি অনুযায়ী বিজয়ী সেনাপতি বন্দি সেনানায়ক নিয়াজরি সামরিক পোশাক থেকে খুলে নেন জেনারেলের ব্যাজ। সেই সাথে যুদ্ধ বন্ধি হয় ৯২ হাজার হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য। ১৯৭১ সালে ভারতের জনগণ এবং সরকারের মধ্যকার সাহায্য-সহযোগিতা পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের এক প্রধান ও অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়। ত্রিপুরার সেই সময় লোক সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ। ৪১১৬ বর্গমাই এলাকার ভেতরে ঐ পরিমাণ জনসংখ্যার পাশাপাশি বাংলাদেশের বাড়িত ১৫ লাখ শরণার্থী মানুষ। শুধু তাই নয়, তার তিন ভাগ এলাকায় পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। ১৯৭১ এর পুরো ন'মাসে ত্রিপুরা হয়ে উঠেছিল মহামানবের মিলন বা তীর্থক্ষেত্র। বিপদের দিনের সেই বন্ধুত্ব আজ ইতিহাস।
নির্ভীক আত্মপ্রত্যয়শীল উচ্চারণ করেছিলেন যিনি, সেই মহৎপ্রাণ মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিহত হন মর্মান্তিকভাবে প্রায় গোটা পরিবারসহ। আগরতলার মাটি যাঁদের পদস্পর্শে একদিন ধন্য হয়েছিল, আরো ৪ শীর্ষস্থানীয় নেতা তাজুউদ্দিন আহমেদ, এম. মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং সৈদয় নজরুল ইসলাম। এইসব স্মৃতি টগবেগ স্মৃতি বুকে নিয়ে আমি আজো বেঁচে আছি। এখনো চোখে ভাসে বাংলাদেশের তরুণ মুক্তিসংগ্রামীদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাবার ছবি। আগরতলার রামনগর স্কুল, বড়দোয়ানী স্কুল, প্রগতি স্কুল ও আসাম রাইফেলসের মাঠে সন্ধ্যার পর ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ভারি কামান ও মর্টারের ছবি আখাউড়ায় শক্তিশালী বাঙ্কার করে পাকিস্তানি বাহিনী সন্ধ্যার পর থেকেই গোলা ছুঁড়তে শুরু করতো। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী পাল্টা গোলা ছুঁড়ে জবাব দিতো। আকাশ-বাতাশ কেঁপে উঠতো। ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
পাকিস্তান বেতার-টেলিভিশনে পাক সামরিক জান্তা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর-ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কী উত্তেজনা! বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার শেষ সংগ্রাম শুরু। তখন জলে-স্থলে-শূন্যে সর্বত্র সব ফ্রন্টে লড়াই। প্রচন্ত লড়াই ত্রিপুরা, আখাউড়া, সিলেট, কুমিল্লা, রামগড় ও ফেনী সেক্টর। লড়াই চলছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় সীমান্তে, পশ্চিমে লাহোর রণাঙ্গনে। বাংলাদেশের অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের যৌথ অভিযানে জেনারেল টিক্কা খান ও জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পর্যুদস্ত। চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে বিশাল সপ্তম নৌবহরকে পাঠালো মার্কিন সরকার। পাল্টা হুমকি দিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৪-১৫ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী জঘন্যতম গণহত্যাভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগরীতে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রখ্যাত অধ্যাপককে পাক সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে গণহত্যা করেছে। বুকভরা বেদনা নিয়েই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের অধিনায়কদের কাছে পাকিস্তানি সেনানায়করা আত্মসমর্পণ করলো। আনন্দের জোয়ারে বাংলাদেশ-ভারতের জনগণ ভাসছেন আমরা আগরতলায় বিজয় মিছিলে পা ফেলছি।’ ( দৈনিক জনতা,১৯ ডিসেম্বর ২০১৫)
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতার সংগ্রামে আগরতলাসহ ভারতবর্ষের মানবতাবাদী মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো বলেই হয় তো শিকল ভাঙার জোয়ার তীব্রতা পেয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি লিখেছেন,‘ এ ছাড়া মানবাধিকার রক্ষার জন্য অবস্থান নেওয়ার ইতিহাসও ভারতের আছে। বস্তুত, সেই ১৯৪৯ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘যেখানে স্বাধীনতা ও ন্যায়িবচার হুমকির মুখে পড়বে বা যেখানে আগ্রাসন হবে, সেখানে আমরা নিরপেক্ষ থাকতে পারি না, আমরা নিরপেক্ষ থাকব না।’ ইন্দিরা গান্ধীও এই ধারা অনুসরণ করেছেন। তিনি নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পণ্ডিত নেহরুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন।’ ( দৈনিক প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬)
বাংলাদেশের মানুষ এখনো ভারতের কাছে প্রত্যাশা করে তাদের প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান ও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য ও সহযোগিতা। লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন