Powered By Blogger

বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৫

আবারও গাইতে হবে তোমাকে




হারুন ইবনে শাহাদাত
 বাংলাদেশ গানের দেশ। এদেশের মানুষ ও প্রকৃতি সবার মাঝে লুকিয়ে আছে সুরের লহরী। জমি চাষের সময় ধান -পাট কাটা. ক্ষেত নিড়ানির সময় কৃষকের কণ্ঠের গানে উদাস হয়ে বয়ে যায় বাতাস। নৌকা বাইবার সময় মাঝির ভাটিয়ালী সুর নদীর পানির ছলাৎ ছলাৎ সুরের সাথে মিশে যে ছন্দ দোলা তোলে তার তুলনা আর কোথাও মিলে না। এই জন্যই হয় তো বলা হয়, প্রাণের দেশ, ধানের দেশ গানের দেশ বাংলাদেশ। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি মনের অজান্তে কোনদিন গান গেয়ে উঠেননি। তারপরও ধর্ম বিশ্বাসের কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ মনে করেন, গান-বাজনা হারাম। 
বাংলা ভাষায় প্রথম গজল ও ইসলামের গানের স্রষ্টা জাতীয কবি কাজী নজরুল ইসলাম
কোরআন-হাদীসের কোথাও এমন কথা লেখা না থাকলেও এমন স্ববিরোধী বিশ্বাস নিয়ে আমৃত্যু বসবাস করেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষ। এমন দ্বন্দ্বের কারণে তাদের মনের মাঝে পাপবোধের বসবাস মানসিক সুসষম বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস এই নিবন্ধ।
ভাল বা ইতিবাচক উদ্দেশ্যে তৈরি জিনিসও কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এ্যাটমিক শক্তি। অনুরূপভাবে একটি ছুড়ি একজন ডাক্তার ব্যবহার করেন জীবন রক্ষার জন্য, অপরদিকে একজন খুনী ও ডাকাত ব্যবহার করে জীবন হরণ করার কাজে। সঙ্গীত বা গান-বাজনার ইতি কিংবা নেতিবাচক দিকও নির্ভর করে গীতিকার ও গায়কের ওপর। গান যেমন মানসিক বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, আবার উল্টো দিকে যৌন উন্মাদনা ও কুভাব সৃষ্টি করে সমাজে বিশৃঙ্খলাও ডেকে আনতে পারে। একজন ডাকাত ছুড়ি দিয়ে মানুষ খুন করছে এই যুক্তি দিয়ে যেমন ডাক্তারের হাত থেকে ছুড়ি কেড়ে নেয়া ঠিক নয়, অনুরূপভাবে চিত্ত বিনোদন ও মানসিক বিকাশের সহায়ক নির্মল সঙ্গীতও নিষিদ্ধ হতে পারে না। ইসলামী আইনশাস্ত্র বা ফিকাহর মূলীতি হলো, ‘যা অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি, তাই বৈধ।সঙ্গীত অবৈধ পবিত্র কোরআনে এমন কোন আয়াত নেই। তারপরও কেউ কেউ কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. এবং সাহাবী ইবনে মাসউদ রা. এর উদ্ধৃতি দিয়ে গানকে অবৈধ বলা হয়। কিন্তু  মদ,সুদ এবং জুয়া নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আল কোরআনে যেভাবে সুষ্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, গিনা,নাগমা,সামা, গান বা সঙ্গীতকে সেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
যারা সঙ্গীতকে হারাম মনে করেন, তারা তাদের যুক্তির পক্ষে সূরা আল: লুকমানের ৬ নম্বর আয়াতের লাহ্ওয়াল হাদীসযার অর্থ অনর্থক বা অপ্রয়োজনীয় গল্প-গুজব বা বাক্য। সুরা নাজমের ৬১ নম্বর আয়াতের সামেদুনবা উদাসীন। সুরা হুজরাতের ৪৯নং আয়াতে সাউতবা গর্দভের স্বর । উল্লেখিত এমন নানান প্রতিশব্দ ব্যবহার করে যারা সঙ্গীত বা গানকে নিষিদ্ধ বলে প্রচার করে, তাদের অবগতির জন্য বলা প্রয়োজন- সঙ্গীতের আরবি প্রতি শব্দ গিনা,নাগমা,সামা ব্যবহৃত হয়নি।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস লাহওয়াল হাদীসেরঅর্থ করেছেন, গান বা অনুরূপ বিষয়সমূহ। লাহ্ওয়া শব্দের অর্থ ব্যাপক, যেমন: খেলা, তামাশা, অসার কথা, অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ,অনর্থক কাজ ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রফেসর ড. আবদুল হালিম ঊধংংু ড়হ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ চধশ-ওহফরধহ গঁংরপ গ্রন্থে লিখেছেন,“আল কোরআনের তফসির সম্বদ্ধে শত শত কথা আলিমম-লী  কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছে। অন্যথায় কয়েকটা সূরাকে কোরআনের অঙ্গ হইতে বাদ দিয়া ফেলিতে হয়। তফসিরের কিতাবেগুলোতে স্বয়ং হযরতের নামকরণে এরূপ শত শত রেওয়ায়েত মুনাফিকগণ কর্তৃক সন্নিবেশিত হইয়া আছে যাহা হযরতের হাদিস কখনই নহে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তফসির বলিয়া যে পুস্তকখানা আমাদের সমাজে পরিচিত,তাহার বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে তদন্ত করিয়া দেখিলে আমরা অনেক রহস্য অবগত হইতে পারিব। ইহার একটি প্রমাণ এই যে, ইবনে আব্বাস এরূপ কথা বলেন নাই। তিনি স্বয়ং সঙ্গীত শ্রবণ করিতেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে।” ( কিবাবুল আগানী)
মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খা ঁ(১৮৬৮-১৯৬৮) তাঁর সঙ্গীত সমস্যা নামক লেখায় লিখেছিলেনঃ আমরা দাবী করিয়া বলিতেছি ত্রিশ পারা কুরানের মধ্যে এরূপ একটি আয়াতও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না, যাহাতে সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ বলিয়া ব্যবস্থা দেয়া হইয়াছে। পক্ষান্তরে হযরত রাসুল করীম সঙ্গীত মাত্রকেই নিষিদ্ধ বা নাজায়েজ বলিয়া আদেশ প্রদান করিয়াছেন এমন একটি ছহি হাদিছ আজ পর্যন্ত খুজিয়া পাওয়া যায় নাই।
তিনি আরো বলেনঃ আমরা অকাট্যরূপে প্রমাণ করিয়া দেখাইবো যে - ১) হযরত রাসুলে কারীম স্বয়ং সঙ্গীত শ্রবণ করিয়াছেন ও তাঁহার অনুমতি এমনকি আদেশ প্রদান করিয়াছেন। ২) হযরতের বহু সাহাবী সঙ্গীত চর্চা করিতেন। ৩) এমাম আবু হানিফা, এমাম মালেক, এমাম শাফেয়ী, এমাম আহম্মদ বিন হাম্বল প্রভৃতি এমামগণ সঙ্গীতকে জায়েজ বলিয়া মনে করিতেন এবং নিজেরাও সঙ্গীত শ্রবণ করিতেন। এমাম মালেক তো নিজেই একজন সঙ্গীত  শাস্ত্রবিশারদ প-িত ছিলেন।
হযরত আয়েশা (রা:) সঙ্গীত ভালবাসতেন। তাঁর ঘরে রাসুল সা. এর উপস্থিতিতেই সঙ্গীত চর্চার উদাহরণ হাদিসে পাওয়া যায়। মিনার এক উৎসবের দিন হযরত আবু বরকর (রা.) হযরত আয়েশার ঘরে এসে দেখেন দুজন গায়িকা বালিকা দফ বা তাম্বুরা বাজিয়ে গান গাইছে। রাসুল সা. হযরত আয়েশা (রা.)কে চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তাঁর নিজের শরীরও পোশাকে আবৃত ছিল।
নবীগৃহে গান বাজনা দেখে হযরত আবু বকর কন্যা আয়েশাকে তিরস্কার করতে আরম্ভব করলেন। মহানবী সা. মুখ তুলে তাকালেন এবং বললেন, আবু বকর! ওদের বিরক্ত করো না- আজ উৎসবের দিন। ( বুখারী, মুসলিম)
হযরত আয়েশার এক বর্ণনায় পাওয়া যায়। তিনি বলেন,‘ আমার ঘরে একটি মেয়ে গান গাইতেছিলো। হযরত উমর ইবন খাত্তাব আমার ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। উমরের পদধ্বনি শোনামাত্র মেয়েটি পালিয়ে গেলো। তা দেখে রাসুল (সা.) মৃদু হাসলেন। এমন অবস্থায় হযরত উমর (রা.) ঘরে প্রবেশ করলেন। উমর জানতে চাইলেন,‘ হে আল্লাহর রাসুল! আপনি হাসছেন কেন?’ রাসুল সা. বললেন,‘ একটি মেয়ে গান গাইছিলো। কিন্তু তোমার পদধ্বনি শোনামাত্র ভয়ে পালিয়ে গেলো।হযরত উমর (রা.) বললেন,‘ আল্লাহর নবী যা শুনেছেন, তা না শোনা পর্যন্ত আমি গৃহ ত্যাগ করছি না।অতপরঃ মহানবী সা. মেয়েটিকে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে গান গাইতে বললেন। আর তিনি তা শুনতে লাগলেন। ( কাশফ আল মাহজুর)।
ইসলামের চার খলিফার মধ্যে হযরত আলী ( রা.) ছাড়া অন্য কেউ সঙ্গীত পছন্দ করতেন না। তবে হারাম মনে করেন না। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ( রা.) মনে করতেন সঙ্গীতের নেশা মানুষকে মদের নেশার মতো নিস্তেজ করে দেয়। এর প্রভাবে মানুষ অলস ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের সরাইখানাগুলোতে পথিকদের আনন্দ দেয়ার জন্য গান-বাজনার ব্যবস্থা ছিলো। সরাইখানার গায়িকাদের মুসান্নিয়া বলা হতো। তারা শুধু গান বাজনার মাধ্যমেই পথিকদের আনন্দ দানে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতেন না। অনেক সময় অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়তো। হযরত আবু বকর (রা.) সরাইখানায় গায়িকা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তার সময় গান বাজনাকে ধরা হতো মালাহী বা নিষিদ্ধ আনন্দ হিসেবে। তবে বিত্তবান ও সম্ভ্রান্ত লোকদের বাড়িতে গায়ক-গায়িকা রাখার যে নিয়ম আরবের সমাজে প্রচলিত ছিল তা নিষিদ্ধ করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) হযরত আবু বকরের মতো সঙ্গীতের ব্যাপারে অতটা কঠোর ছিলেন না। ইবনে হিশামের বর্ণনায় দেখা যায় হযরত উমর (রা.) এর ছেলে হযরত আসীম (রা.) সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন, অথচ হযরত উমর (রা.) তাকে বাধা দেননি।  ( ইবনে হিশাম-৭৮২ পৃষ্ঠা) । এ কথা কারো অজানা নয় ইসলামের অনুশাসন পালনের ব্যাপারে হযরত উমর (রা,) এতটাই কঠোর ছিলেন যে, মদ পানের অপরাধে তিনি নিজ পুত্র আবু শামাকে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বেত্রাঘাত শাস্তি দিয়েছিলেন। শাস্তি নির্ধারিত বেত্রাঘাতের আগেই তার মৃত্যু হলে বাকী বেত্রাঘাত তার কবরের ওপর করা হয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, হযরত উমর (রা.) নুসব জাতীয় গান গাওয়ার কারণে তার ছেলে আসীমকে গর্দভ বলে ভৎসনা করেছেন। কারণ নুসব শব্দের অর্থ পাথর। এ জাতীয় গান দেবী লাতের বন্দনা গাওয়া হতো। জীবন শুধু ভোগের জন্যকয়েকজন গায়িকার কণ্ঠের গানে এমন বাণী থাকায় হযরত উমর (রা.) তাদেরকে তিরস্কার করেছেন এবং হাল্কা লাঠি দিয়ে আঘাত করেছেন।
হযরত উসমান (রা.)-এর সময় সঙ্গীতের অবস্থা সম্পর্কে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক এ জেড এম শামসুল আলম তার মুসলিম সঙ্গীত চর্চার সোনালী ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন,‘হযরত উসমান (রা.)-এর আমলে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থতির কিছুটা পরিবর্তন বা উন্নয়ন সাধিত হয়। হযরত উমার (রা.) মক্কা ও মদিনাবাসীদের অন্যত্র বসবাসের অনুমতি দিতেন না। হযরত উমার (রা.) এর খিলাফতকালে মহানবীর সাহাবাদের মদীনাতেই থাকতে হতো। সাহাবীদের ইচ্ছে মতো জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে দেয়া হয়নি।
হযরত উসমান ( রা.) পূর্ববতী খলিফার বিধি নিষেধ তুলে দেন।.. বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে প্রচুর বিত্ত সম্পদ মদীনায় আসতে শুরু করে। অর্থনৈতিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরাম -আয়েশ এবং বিলাসের দিকে বিত্তশালীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।.. পূর্ববর্তী  যুগে সঙ্গীত চর্চার প্রতি যেটুকু বিধি-নিষেধ ছিল, নয়া সামাজিক পরিস্থিতিতে তা শিথিল হয়ে পড়ে। যদিও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিগণ তাতে অসন্তষ্টি প্রকাশ করেন এবং প্রতিবাদ করেন। কিন্তু  নয়া সামাজিক গতিধারা রোধ করতে পারেন নি।’ (মুসলিম সঙ্গীত চর্চার সোনালী ইতিহাস পৃষ্ঠা-৫৭-৫৮)
ইমামদের মধ্যে ইমাম শাফেয়ী ( র.) সঙ্গীতের ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর মনোভাব পোষণ করেছেন বলে মনে করা হয়। তারপরও তিনি সঙ্গীতকে হারাম বলেন নি। আদাবুল কাজারে তিনি লিখেছেন,‘সঙ্গীত চর্চা মাকরূহ, কারণ তা বাতিলের অনুরূপ। যা বাতিল তা অকেজো এবং অপ্রয়োজনীয়। যে সঙ্গীত চর্চায় ডুবে আছে- সে অজ্ঞ এবং তার সাক্ষ্য গ্রহণীয় নয়।অবশ্য তিনি উট চালকদের হাদা বা কারাজ সঙ্গীত বৈধ মনে করতেন। ইমাম শাফেয়ী (র.) বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেললে তা দ-নীয় নয় বলে অভিমত দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি এগুলোর সম্পদ হিসেবে কোন মূল্য নেই। ( আল নামায়ি-পৃষ্ঠা-২০০)। ইমাম আবু হামিদ আল গাজ্জালী (র.) ইমাম শাফেয়ীর এই মতামতের সমালোচনা করে বলেছেন, যা অপ্রয়োজনীয় তা স্বভাবতই নিষিদ্ধ হতে পারে না। তিনি আবিসিনিয়ানদের নাচ এবং গানের উপমা দিয়ে বলেন, এগুলো ছিল বাতিল। কিন্তু বিশ্বনবী ( সা.) তা উপভোগ করেছেন এবং এগুলোকে মাকরূহ ঘোষণা করেন নি। ইমাম আবু আল গাজ্জালী (রা.) আবও লিখেছেন,‘ যখন ইমাম শাফেয়ী (রা.) লিখেছেন সঙ্গীত মাকরূহ তখন তিনি হয়ত প্রকৃত পক্ষে মাকরূহ তানজিহি-ই ধরেছেন যা হালালের নিকটবর্তী।ইমাম শাফেয়ী (রা.) সঙ্গীত পছন্দ করতেন না, এর ভিন্ন মত পাওয়া মাওলানা আকরাম খাঁর লেখায় । তিনি লিখেছেন,‘অনেক কিতাবে আছে ইমাম শাফেয়ী নিজেই সঙ্গীত উপভোগ করেছেন ( আজাকির আলী কারী,আবদুল গনী নাবলাসী) । আল্লামা আলী কারী হানাফী সামা নামের এক গ্রন্থে লিখেছেন,‘ ইমাম আবু হানিফা ( রা.) সঙ্গীত শোনতেন। ইমাম ইউসুফ খলিফা হারুন অর রশীদের দরবারে সঙ্গীত শোনতেন।
মাওলানা আকরাম খাঁ আবদুল গনি নবলিসীর বরাত দিয়ে লিখেছেন,‘ ইমাম মালিক নিজে গান খাইতেন এবং অপরের গাওয়া গান উপভোগ করতেন। রাগ-রাগিণীর মধ্যে ভুল থাকলে তা শুদ্ধ করে দিতেন। তাকে সঙ্গীত সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হলে তিনি জবাব দেন,‘ অশিক্ষিত,মূর্খ এবং হৃদয়হীন ব্যতীত অপর কেউ সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ মনে করতে পারে না।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল  সঙ্গীত পছন্দ করতেন না এমন প্রচলিত মতের বিরোধী মতও আছে। তাঁর পুত্র সঙ্গীত ভক্ত ছিলেন। একদিন তাঁর পুত্রের জলসায় তিনি এসে হাজির হলে পুত্র তাঁকে বলেন, আপনি তো সঙ্গীত পছন্দ করেন না । উত্তরে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বলেন, শুধু ঐ জাতীয় সঙ্গীত নিষিদ্ধ যা হৃদয়ে অসৎ ভাব সৃষ্টি করে।
এই নিবন্ধকার বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদ ড. ইউসুফ আল কারজাভির একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তাঁকে করেছিলেন, বাঁশি বাজিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন বৈধ কিনা? উত্তরে তিনি বলেন, ড্রাম, বাঁশি বা অন্য কোন বাদ্য যন্ত্র কোন বিষয় নয়, গানের ভাষা ও ভাব যদি ইসলাম বিরোধী বা মনে কুভাব সৃষ্টিকারী না হয় তাহলে সঙ্গীত বৈধ।
 কোরআন হাদীস ও ইসলামী আইন শাস্ত্র মতে, মনে ভাল ভাব সৃষ্টিকারী শালীন সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র বৈধ হওয়ার পরও বর্তকালের আলেমদের সঙ্গীত হারাম মনে করার কারণ প্রসঙ্গে ইসলামী ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক এ জেড এম শামসুল আলম লিখেছেন,‘ মুসলিম সমাজে সঙ্গীত চর্চার প্রতি উদাসীনতা এবং পরবর্তীকালে বিরোধীতার একটি কারণ সঙ্গীতের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা,) এর উৎসাহের অভাব এবং হযরত আবু বকর (রা.) এর গভীর বিতৃষ্ণা। হযরত আয়েশা (রা.) এর গৃহে যখন গান হতো, তাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) খুব উৎসাহ প্রকাশ করতেন না, বাধাও দিতেন না। তিনি যে গান ঘৃণা করতেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
আল-কুরআনে সুমষ্টি সুরের প্রশংসা আছে। আল্লাহর ধ্যান  এবং  জাতির কল্যাণে যিনি প্রতি মৃহূর্তে বিভোর থাকতেন,তাঁর পক্ষে গানের সমঝদার হওয়ার মতো সময় এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ইসলামের প্রাথমিক যুগে এবং খলীফাদের যুগে ছিলো না। সঙ্গীতের প্রতি তাঁদের উদাসিনতা পরবর্তী যুগে এবং পরবর্তী যুগের আলিমদের সঙ্গীত বিরোধিতার পটভূমি হিসেবে কাজ করে।
সর্বপ্রথম সুরের মুর্চ্ছনায় ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানদের ঘুম ভাঙিয়েছেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর এই দুঃসাহসী পথের সাথী ছিলেন  শিল্পী কে. মল্লিক ও মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ। শিল্পী কে. মল্লিকই প্রথম বাঙালি মুসলমান যার গান গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণ করা হয়। ‘‘ফুলবাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে দোল’’ গানটি কে. মল্লিকের গাওয়া প্রথম নজরুল গীতি। কে. মল্লিককে সঙ্গীতে বাঙালি মুসলমান কণ্ঠশিল্পীদের পথ প্রদর্শক মনে করা হয়। আব্বাস উদ্দীন আহমদ শিল্পী কে. মল্লিক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘আমি মুসলমান একথা জানতে পেরে তিনি প্রথম আত্মীয়তার সুরেই আমাকে বললেন, কি গান রেকর্ড করবে গাও দেখি একবার।উল্লেখ্য, কে. মল্লিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রথম মুসলিম গায়ক। বিশ শতকের শুরুর দিক  থেকে উপমহাদেশে গ্রামোফোন কোম্পানীগুলো গানের রেকর্ড বের করা শুরু করে। কে. মল্লিক সেই প্রথম যুগের একজন সফল ও জনপ্রিয় শিল্পী। তার পুরো নাম মুন্সী মুহাম্মদ কাসেম ওরফে মানু মিয়া। কণ্ঠশিল্পী মুসলমান এ কথা জানলে গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি হবে না, এই ভয়ে কোম্পনীর মালিক গোরাচাঁদ মল্লিক তার গান বাজারজাত করার আগে রেকর্ডের গায়ে আবুল কাসেম না লিখে নতুন নাম কে. মল্লিক লেখেন। তিনি হিন্দু  না মুসলমান তা লুকানোর জন্য।
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা এ নিবন্ধকারকে বলেছিলেন, গবেষক সাংবাদিক মরহুম শাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেছিলেন,‘ শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের এক জনসভায় ঘোষণা করা হলো, কাজী নজরুল ইসলাম গান গাইবেন। নাম ঘোষণার সাথে সাথে,‘ হিন্দু ঘেঁষা, হাফ মুসলমান নজরুল, গাইবে কুফরি গানবলতে বলতে জনসভায় উপস্থিত আলেমরা উঠে হাঁটা শুরু করলেন। নজরুল গেয়ে উঠলেন,‘
আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান।
 কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবন- মৃত্য- জ্ঞান।।
যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম;
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জ্বীন পরী ইনসান।।

স্ত্রী- পুত্ররে আল্লারে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক
 হেসে কোরবানী দিত প্রাণ, হায়! আজ তারা মাগে ভিখ।
 কোথা  সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা,
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে ল'য়ে কোরান।
কাজী নজরুল ইসলামের গানের শব্দ ও সুরে আলেমদের পা আঁটকে গেলো। তারা আবার ফিরে এলেন। মঞ্চে গিয়ে নজরুলের পাশে বসলেন। গান শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে নজরুলের সাথে বুক মিলিয়ে বললেন, ‘আপনি মুসলমানদের গর্ব।
আজকের মুসলমান গীতিকারদের দায়িত্ব বিভ্রান্ত,অজ্ঞ, মুসলমানদের জাগানো। অজ্ঞতার এই আঁধার কাটাতেই মুসলমান শিল্পীদেরকে আবারও গাইতে হবে এমন জাগনরণের গান। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক। দৈনিক নয়াদিগন্ত ঈদসংখ্যা ২০১৫ এ প্রকাশিত  B-‡gBj:harunibnshahadat@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন