Powered By Blogger

মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৫

লবণাক্ততা : বছরে ক্ষতি ২২ কোটি টাকা




মো. আবদুস সালিম

মাটিতে দিন দিন লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। লবণাক্ততার বেশি শিকার উপকূলীয় অঞ্চল। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত এলাকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোতেও। কৃষি ব্যবস্থাপনা ও শস্য বিন্যাসে পড়ছে লবণের বিরূপ প্রভাব। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছে, আমাদের দেশের মোট আবাদযোগ্য ভূমির প্রায় ৩০ ভাগ জমি পড়েছে উপকূল এলাকায়। আরও বলা হয়েছে, উপকূলীয় ২ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ০.৮৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিই নানাভাবে লবণাক্ততায় প্রভাবিত। গত কয়েক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে লবণের মাত্রা প্রায় ২৭ ভাগ বেড়েছে। আর গত এক দশকে এর মাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ভাগ। বর্তমানে দেশে লবণাক্ত মাটি আছে ৯৩টি উপজেলা এবং ১৮টি জেলায়। তার মধ্যে অন্যতম স্থান সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, পিরোজপুর, নড়াইল ও খুলনা। বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, উপকূল থেকে লবণ যেভাবে পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে আগামী কয়েক দশকে বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে তিন কোটি মানুষের জীবন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। এতে করে দেখা দেবে চরম মানবিক ও জৈবিক বিপর্যয়।

লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলে লবণ ছড়িয়ে পড়ছে প্রধাণত দুভাগে। এক. সাগরের পানিতে প্লাবিত হয়ে দুই. মাটির নিচের স্তর বা ভূগর্ভ থেকে ওপরে উঠে এসে। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল এলে দক্ষিণাঞ্চলে জোয়ারের পানি আসে। তাতে বহু আবাদি জমি তলিয়ে যায়। ওইসব মাটিতে লবণ ছড়িয়ে পড়ে। এ পানিতে থাকে ক্ষতিকর মাত্রার লবণ। এ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হলে মাটি বা জমি লবণাক্ত হয়। এদিকে জমি বা মাটি শুকিয়ে যায় ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ফেব্রয়ারি-মার্চে। এ সময় মাটির ফাটলের গর্ত দিয়ে মাটির ওপরে চলে আসে ভূগর্ভস্থ লবণ পানি। এরপর রোদে ও তাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যায় পানি। এভাবে জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে লবণ। তবে অনেক স্থানে লবণ ছড়ানোর জন্য দায়ী চিংড়ি চাষীরা। তারা আবাদি জমিতে লবণপানি প্রবেশ করায় চিংড়ি চাষের জন্য।
শুকনো মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে লবণ ছাড়া পানি মেলে না। এ কারণে অনেক স্থানের খাল-নদীতে কমবেশি পানি থাকার পরও কৃষকরা সেচ দিতে পারছে না। যারা এসবে তোয়াক্কা না করে জমিতে সেচ দেন, তাদের জমিই লবণাক্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, লবণের কারণে ফসলের উৎপাদন কমে যায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। এমনকি অনেক সময় লবণ বেশি হলে কোনো উৎপাদনই হয় না। মাটির উর্বরতা এবং গাছের বৃদ্ধি হ্রাস পায় লবণের প্রভাবে। তাতে ফুল আসে না, পরাগায়নে বাধা পায়। তবে রোপা আমনে তা খুব ক্ষতি করে না। যত সমস্যা রবি শস্যের। কারণ রবিশস্য লবণসহিষ্ণু নয়। তিন ফসলি জমি দুই ফসলি, এমনকি এক ফসলি হয়ে যাচ্ছে লবণ বিস্তারের কারণে। শস্য বিন্যাসও বদলে যাচ্ছে। যেমন লবণের প্রভাবে গত কয়েক বছরে ঝালকাঠিতে এক হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে এসেছে। ধানের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার টন। বিপরীতে বেড়েছে লোকসংখ্যা। এদিকে অশনিসংকেত অপেক্ষা করছে শাকসবজির উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয়ও। মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে বেশি হয় মৃত্তিকা দ্রবণের ঘনত্ব। তখন অল্প ঘনত্বের গাছের রস চলে যায় মাটিতে। ফলে পানিশূন্য হয়ে পড়ে গাছ এবং তা নেতিয়ে পড়ে। লবণাক্ত জমিতে দ্রবীভূত লবণের মাত্রা বা পরিমাণ বেশি থাকায় গাছ মাটি থেকে খাদ্য উৎপাদন ও পানি উভয়ই সহজে শোষণ করতে পারে না। প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয় শোষিত উপাদানসমূহের আত্তীকরণেও। মাটিতে হ্রাস পায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং জিংকের মাত্রা। বছর কয়েক আগেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ ছিল না ভোলার উপকূলীয় মেঘনার পানিতে। কিন্তু হঠাৎ করে সেখানেও দেখা দিয়েছে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। স্বাভাবিক লবণের মাত্রা থাকার কথা সর্বোচ্চ দশমিক ৭৫ ইসিডিএম/মিটার। কিন্তু মেঘনা নদীর ভোলা অঞ্চলের অনেক স্থানের পানিতে লবণাক্তার পরিমাণ হয়েছে প্রায় ২২ ইসিডিএম/মি.। সাধারণত বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তিন ভাগ লবণাক্ততাকে। লবণাক্ততার এ ভয়াবহ বৃদ্ধিকে বিশেষজ্ঞ গবেষকরা দেখছেন রেড এলার্টহিসেবে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির এ উদ্বেগজনক তথ্য ধরা পড়েছে বরিশালের মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউট ও কৃষি বিভাগের এসআরডিআইতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রে জানান হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে প্রতি বছর আমাদের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২২ কোটি টাকা। এর বিরুদ্ধে কার্যকর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলেও জানান তারা। লবণাক্ততার ফলে কৃষিতে বিপর্যয় তো দেখা দিয়েছেই, তার ওপরে আবার বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব, গৃহপালিত পশুপাখি এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যর্থতাসহ তৈরি হচ্ছে নানা সংকট। বড় বড় গাছপালা মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীও ধ্বংস হচ্ছে। সুন্দরবনের সুন্দরীসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মরে যাচ্ছে। তাতে পশুপাখির আবাসস্থল অরক্ষিত হচ্ছে। এসব কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর্থ-সামাজিক সমস্যাও। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ বেড়ে যাচ্ছে সুপেয় পানির সংকটে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও কৃষি জমি হ্রাসের বিষয়টি ক্রমেই মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সুন্দরবন এলাকাতেও। প্রতি বছর বিস্তীর্ণ চাষাবাদের জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট করেছে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার আঘাতে। দফায় দফায় বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার হচ্ছে না দীর্ঘদিনেও। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা রীতিমতো হতাশাজনক। ভারতকর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য যেন আরেক মরণফাঁদ।
মাটির লবণাক্ততা দূরীকরণে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পদ্ধতির কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, লবণাক্ততা মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করার জন্য দ্রবণীয় লবণকে মাটি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। লবণাক্ত মাটিতে পুনরুদ্ধার বা পরিশোধন করার জন্য কয়েকটি পদ্ধতির কথা জানান তারা। এক. জমির ওপর যদি খুব বেশি লবণ জমে যায় তবে তা চেঁছে পরিষ্কার করলে লবণাক্ততা হ্রাস পায়। অনেক সময় লবণ পরিষ্কার করার পর অন্য স্থান থেকে লবণাক্ত মাটি এনে ওই স্থান ভরাট করা হয়। পানির সঙ্গে লবণ উঠে আসার কারণে দিন কয়েক পর আবার লবণাক্ত হয়ে পড়ে জমি। সীমিত ছোট এলাকার জন্য প্রযোজ্য এ পদ্ধতি।
দুই. ৮ থেকে ১০ ফুট নিচে থাকা উচিত ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা। পানির উচ্চতাকে সুবিধাজনকভাবে নিচে রাখা যায় পানি নিষ্কাশনের দ্বারা। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু বা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবৃত্ত নালা, টালি নালা, খোলা নালা ইত্যাদির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কুয়া থেকে পানি বের করে আনা যায় পাম্প করে। তিন. লবণজাতীয় পদার্থগুলোকে পানিতে দ্রবীভূত করা যায় প্লাবন সেচের মাধ্যমে। দ্রবীভূত এ লবণ ধুয়ে জমি থেকে নামিয়ে আনা যায় প্লাবনের মাধ্যমে। এরপর ক্ষেতে সমন্বিত রেখা বরাবর ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে নেয়া যায়, আর প্রতিটি জমিতে আইল বেঁধে উঁচু করা যায় এবং ঢালের আড়াআড়িভাবে তা ভেলির মতো দেখা যায়। এরপর প্রতিটি জমি ভালোভাবে প্লাবিত করে দিতে হয় পানি সেচের মাধ্যমে। চার. নানা প্রক্রিয়ায় জমির লবণ হ্রাস করার পর লবণসহিষ্ণু ফসল চাষ করতে হবে। এছাড়া জৈব ও সবুজ সার মাটিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ থেকে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হবে তা লবণাক্ততা হ্রাসে সাহায্য করবে। পাঁচ. উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত পানির সাহায্যে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। এতে বাড়ছে লবণের ঝুঁকি। তাই এর পরিবর্তে চাষ করা যেতে পারে মিঠা পানির মাছ।
লবণাক্ততার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছে। লবণাক্ততার মাত্রা কমিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের জীববৈচিত্র্য ও কৃষি।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন