লেখক হারুন ইবনে শাহাদাত |
॥ হারুন ইবনে শাহাদাত॥
ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র।’ এই কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, আমিই রাষ্ট্র দর্শনের মূল কথা হলোÑ আমার কথা ও বক্তৃতা বিবৃতি হলো সংবিধান। আমার কাজ হলো গণতন্ত্র। আমার ধমক হলো আইনের শাসন। সম্রাট, রাজা-বাদশাদের শাসন এখন আর কোনো সুসভ্য দেশে নেই। কিন্তু তাদের অনুসৃত নীতি থেকে মুক্ত নন কোনো স্বৈরাচারী শাসক। নানান রূপে তারা বার বার ফিরে আসেন এবং জনগণের কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজেরাই মালিক হয়ে বসেন। জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে সরকারি টাকা মানে জনগণের অর্থে লালিত-পালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেন। সরকার পরিবর্তনের বৈধ প্রক্রিয়ায় অন্যের
![]() |
শিল্পীর চোখে ফারসি বিপ্লবের সময় বাস্তিল দুর্গের পতন |
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তারা সরকারি টাকায় ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছেন। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তাদের অফিসের তালা খুলে বসার সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছেন না। নাশকতা মামলার মোড়কে রাজনৈতিক মামলা দিয়ে নানান ছলছুতায় তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতির মাঠ ও জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ একের পর এক নীলনকশা আঁকছে। কিন্তু তারপরও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন নীরব। প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীন মর্যাদা হারিয়ে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিরোধী নেত্রীকে মিথ্যা মামলায় জেলে রাখা হয়েছে। বিরোধী দলকে ঘরের মধ্যেও মিটিং করতে দিচ্ছে না। অথচ যারা সরকারে আছেন, তারা সরকারি উড়োজাহাজ ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এটা ফেয়ার নয়। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ শুধু ভোট নেয়া নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার সংরক্ষণ ও আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তাদের। তারা একটি চিঠি ইস্যু করতে পারেÑ সরকারি টাকা খরচ করে নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করার কথা উল্লেখ্য করে।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা
সরকারি দলের নেতারা জনগণের টাকা খরচ করে প্রচারণা চালাচ্ছে; অথচ নির্বাচন কমিশন নীবর। তাদের এই নীরবতা লক্ষ করে বিশিষ্টজনরা কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম নয়। ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা মতোই চলছে ওই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এমন নানা অভিযোগ তুলে দেশের বিশিষ্টজনরা স্বাধীনতার চেতনা, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ তৈরিতে এখনও ইসি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের কোনো তৎপরতাও নেই। বরং তারা বলছে, নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার আগে লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড করা যাবে না। এটা হতে পারে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ তৈরি করা ইসি’র সাংবিধানিক দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য যা যা করা দরকার, তা-ই তাদের করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, আমাদের বড় ব্যর্থতা দেশে সরকার আছে, কিন্তু জনগণ ভোট দিতে পারছে না। আমরা এমন এক পদ্ধতি চাচ্ছি, যার দ্বারা জনগণের পার্লামেন্ট গঠিত হয়। বর্তমান অবস্থায় সুশীল সমাজের কিছু করার নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, সবাই ভয়ভীতি আর আতঙ্কের মধ্যে আছে। গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে চাটুকার আর দুর্নীতিবাজদের বিজয় হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেখানে জনগণের ভোটের অধিকার থাকে না, সেখানে চাটুকারিতা থাকে। দুর্নীতি থাকে। নির্বাচনে চুরি বা দুর্নীতি সব দুর্নীতির জন্মদাতা। আজকে বাংলাদেশে চাটুকার আর দুর্নীতিপরায়ণরা একটা ক্লাস আর বাকি নাগরিকরা একটা ক্লাস। এ অবস্থার অবসান হতে হবে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভোটে যাওয়ার সাহস নেই মন্তব্য করে ব্যারিস্টার মইনুল বলেন, অনেকে স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, স্বাধীনতার চেতনা সূর্য কিংবা চাঁদের আলো (সান লাইট বা মুন লাইট) নয়। গণতন্ত্রই স্বাধীনতার চেতনা। যারা গণতন্ত্রবিরোধী, তারা স্বাধীনতার চেতনার বিপক্ষ শক্তি। তার মতে, তিনিসহ যারা গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকারের কথা বলেন, তারাই প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সরকারি সুবিধা ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। আর বিরোধীরা ঘরেও অনুষ্ঠান করতে পারছেন না। ইসি বলছেন, তারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবেন। কিন্তু তার কোনো আলামত নেই। ইসি’র ভূমিকা কীÑ এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ইসি কোনো পদক্ষেপ নেবে, তা বিশ্বাস করারও কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংসদও তাই একদলীয় হয়ে গেছে। বিএনপির ওই নেতা বলেন, প্রশাসন দলীয়করণের চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। আর বিচার ব্যবস্থা, সেখানে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। দেশ ছাড়তেও বাধ্য হয়েছেন তিনি।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে জরুরি হচ্ছে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠান। এগুলো ছাড়া গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব নয়। সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ট্রাম্প, কিন্তু তাকেও অভিবাসন বিল নিয়ে ধাক্কা খেতে হয়েছে। কারণ সেখানে ইনস্টিটিউশনস বা সিস্টেম রয়েছে।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, কোনো সভ্য রাষ্ট্রে নির্বাচন নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা থাকে না। নির্বাচন কি আদৌ হচ্ছে? নির্বাচনটি কী রকম হবে? সেখানে কি বিরোধী দল অংশ নেবে? যদি অংশ নেয় তবে নির্বাচন কি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে? আমি কি আমার ভোটটি দিতে পারবো? ভোটটি কি গণনা হবে? এমন প্রশ্ন কারো মুখে শোনা যায় না। কিন্তু আমাদের এখানে মুখে মুখেই তা শোনা যায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
অবাধ নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কারণ
আওয়ামী লীগ সরকার কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তা আরো বদ্ধমূল হয়েছে গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন একতরফা একদলীয় নির্বাচনের পর। দেশের সবচেয়ে বড় দু’টি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতাদের সাথে অরাজনীতিসুলভ ও অগণতান্ত্রিক আচরণ; বিশেষ করে রাজনীতির মাঠ থেকে তাদের সরানো হয়েছে। বিশেষ কায়দায় হত্যা করে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর ও মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য মীর কাসেম আলী, বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সরিয়ে দেয়ার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতারের পর সরকারের একদলীয় অগণতান্ত্রিক শাসনপ্রীতির ব্যাপারে জনমনে আর কোনো সন্দেহ নেই।
বাস্তিল দুর্গেরও পতন হয়েছিল
জনগণের মন থেকে এই সন্দেহ দূর করার দায়িত্ব সরকারের। আগামী জাতীয় নির্বাচনই হতে পারে সন্দেহ ও সংশয় দূর করার মোক্ষম হাতিয়ার। কারণ নির্বাচনই ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং জনগণের আস্থা নিয়ে টিকে থাকার সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সেই সুযোগকে কাজে না লাগালে পরিণতি যে কতটা খারাপ হতে পারে, সেই উদাহরণ দিতে আবার ফ্রান্সের লুইদের কাছে যেতে হচ্ছে। সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের অত্যাচার নির্যাতনের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতন হয়েছিল ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ জনগণের হাতে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত ‘থার্ড স্টেট’ বা সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই বিপ্লবের আগে সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ। অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষই কোনো আয়কর দিত না। যারা আয়কর দিত, তারা তেমন কোনো সুযোগ ভোগ করতে পারত না। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করত, তাদের বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে নির্যাতন করা হতো। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। বন্দিদের রাখা হতো এই দুর্গে। একবার তার মধ্যে প্রবেশ করলে জীবিতকালে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকত না। কারাগারের ভেতরেই মেরে ফেলা হতো বহু বন্দিকে। অত্যাচারে জর্জরিত ফরাসি জনসাধারণ ওই তারিখে বাস্তিলের দুর্গ ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করে। তাদের স্লোগান ছিলÑ স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব। ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই দেশবাসীর সুখ-দুঃখ দূরের কথা, নিজেদের প্রত্যাসন্ন বিপদেরও কোনো খোঁজখবর রাখতেন না। চাটুকারদের প্ররোচনায় রাজা অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন প্রজাদের ওপর। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই নির্বাচিত প্রতিনিধি, রক্ষীবাহিনীর সদস্য এবং বাস্তিল দুর্গের আশপাশের মানুষ বাস্তিল অভিমুখে রওনা হন। প্রতিনিধিরা রক্তক্ষয় এড়াতে বাস্তিল দুর্গের প্রধান দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। লক্ষ্য ছিল বাস্তিলে অবস্থিত ৭ জন রাজবন্দিকে মুক্ত করা। কিন্তু দ্য লোন প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেন। জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়েন, জনতার ঢেউ আছড়ে পড়ে বাস্তিল দুর্গে, বাস্তিলের রক্ষীরাও কামান দাগাতে শুরু করে। প্রায় দুইশ’ বিপ্লবী মানুষ হতাহত হন। এরপর চারদিক থেকে উত্তেজিত ক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দূর্গ ধ্বংস করেন। পতন হয় স্বৈরাচারী শাসকের, ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয় শোষিত, নির্যাতিত মানুষের জয়ের নতুন এক উপাখ্যান, যার নাম ফরাসি বিপ্লব। অথচ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংলাপের দ্বার খোলা রাখলে হয়তো বা ফ্রান্সের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার, সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ অবশ্যই বের করবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই দেশকে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। কারণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। ইতিহাস তাদের কোনোদিন ক্ষমা করে না।-সূত্র: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা ২-৩-২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন