আনোয়ার চৌধুরী
একবিংশ শতাব্দীতেও বিশ্বায়নের
সংজ্ঞা নিয়ে সমাজ চিন্তাবিদদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বায়ন
কি ধনতান্ত্রিক সমাজের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসন? অথবা ম্যাকডোনারাইজেশন, নাকি
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন? কেউ কেউ আবার সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, বিশ্ব-বৈশ্বিকগ্রাম এসব প্রপঞ্চ দিয়েও ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বায়নকে।
বিশ্বায়ন একটি পুরনো প্রত্যয় এবং শুধু পশ্চিমাকরণ নয়। বিশ্বায়নের ঢেউয়ের ধারাবাহিকতায় জ্ঞানের বিকাশ ধর্মের প্রসার, মানুষ পণ্য, প্রযুক্তি ও ভাষার
গতিশীলতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু আগেই শুরু হয়েছে। যেমন সীমান্ত ছাড়িয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অন্য ধর্ম অথবা চীনে ইসলাম
ধর্মের প্রসার ঘটে অথবা ইংরেজি
সর্বজনীন ভাষায় পরিণত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক রাষ্ট্র,
অলিম্পিক, ইউরোপের বাইরে প্রসারিত হতে থাকে। আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক এই সময়েও বলেছেন, বিশ্বায়নের
কেন্দ্রে ছিল চীন ও ভারত। বিশ্বায়নের
ইতিবাচক দিক হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দারিদ্র্য উপশম-নিরসন ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারকে ইঙ্গিত করা হয়।
আর এর নেতিবাচক দিকগুলোর উল্লেখ
বহু পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত_সেগুলো হলো সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা,
দাসত্ব, সমাজে চরম অসমতা সৃষ্টি। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমা বিশ্বের একচ্ছত্র
আধিপত্য খর্ব হতে দেখা যায়। উদ্ভব হয় বহুজাতিক কম্পানির। বাজার ব্যবস্থার নতুন মাত্রা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোকে শক্তিশালী করে
তোলে। উত্তর-আধুনিকতাবাদী অনেক
তাত্তি্বক তাই নতুন করে সমাজ সম্পর্কে
তত্ত্ব দিতে শুরু করেন। বহুজাতিক কম্পানিগুলোকে এ সময়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারমাধ্যম। আর এ মাধ্যমে
বিভিন্ন আদর্শ ও মতবাদ পুরো
বিশ্বকে জয় করে নিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে যেসব সংকট তৈরি হচ্ছে, তার পেছনে কোনো বিশ্বযুদ্ধ
নেই বা তা সমাধানের জন্য কোনো একক শক্তি নেই, বরং সব নিয়ন্ত্রণ করছে প্রযুক্তি ও প্রচারনির্ভর বাজারব্যবস্থা।
সংকট নিরসনে রাষ্ট্র যেন আর
নিজের অবস্থানে থাকতে পারছে না। বিশ্বায়ন একটি প্রাচীন প্রক্রিয়া এবং তার কিছু সুফলও আছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্র ও নাগরিকদের স্বাধীনতা এবং
সার্বভৌমত্ব যে বিশ্বায়নের ফলে হুমকির মুখে পড়ছে, সে
প্রশ্ন কি আজও আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না?
একটি
দুর্বল রাষ্ট্রের
নীতিমালা বা প্রতিশ্রুতি
পূরণ নির্ভর করছে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর
ওপর_তারা আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা,
চীন, ভারত, জাপান যে-ই হোক না কেন। অর্থনৈতিকভাবে
দুর্বল দেশগুলোর নিজস্ব বাজারব্যবস্থা পরাজিত হয় বিদেশি বিনিয়োগের কাছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে
থাকার জন্য শিল্পের ওপরই নির্ভর করতে
হয়। অথবা বড়জোর নির্ভর করতে হয় মানবসম্পদের ওপর। বর্তমান বিশ্বায়ন তাই একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের রাজনৈতিক শক্তি ও
অনুপস্থিত অর্থনৈতিক শক্তির মাঝে
ক্ষমতার খেলা। সে খেলা বস্তুত জন্ম দেয় অনিশ্চয়তার ও ঝুঁকির রাজনৈতিক অর্থনীতি। বিশ্বায়নের মাধ্যমে ছাড়িয়ে যাওয়া
প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবসমাজ
নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করেছে হয়তোবা, কিন্তু
প্রাণহীন করছে অন্যান্য প্রজাতি ও
জীববৈচিত্র্যকে। পরিবেশগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনের
বিচ্ছিন্নতা প্রযুক্তিকেন্দ্রিকতার সরাসরি ফল। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ফলে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুর্বল
দেশগুলো। কোপেনহেগেনের আন্তর্জাতিক
সম্মেলনে এটি যেমন স্বীকার করা হয়েছে, তেমনি
এশীয় দেশগুলো যে সবচেয়ে ক্ষতির
মুখে পড়বে, তাও তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কার্বন
নির্গমনকারী দেশগুলোর মতো আমরা নিজেরাও জানি না, সম্পদ উৎপাদন ও ব্যবহার
ঝুঁকিকেও সামাজিকভাবে উৎপাদন করছে। বিশ্বায়নের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর-আধুনিকতাবাদী তাত্তি্বকদের প্রচারমাধ্যমকে
সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে
দেখানোকে তখনই সাধুবাদ দেওয়া যাবে যখন প্রচারমাধ্যমে এ ঝুঁকিগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও তার নিরসনে ব্যাপক সহায়তা করবে। সার্বভৌম রাষ্ট্রকে তার
নিজের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে এ মাধ্যমই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভোগবিলাসী জীবনে এ
উপমহাদেশের বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষের
অংশগ্রহণ নেই। কার্বন নির্গমনের হার শূন্যের কোঠায়। তবু কেন তারা জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ অবক্ষয়ের জন্য
সবচেয়ে বেশি মূল্য দেবে? সনাতনী ঢঙে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ
বা পশ্চিমা শক্তিকে
মোকাবিলা করতে না পারলেও
নিজেদের জ্ঞান দিয়ে নিজেদের দুর্যোগকে আমরা মোকাবিলা করেছি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণের জন্য যেখানে
কোপেনহেগেনে কার্যকর অংশগ্রহণ করে
কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি, সেখানে রাজপথে দাঁড়িয়ে
নদী বাঁচাও, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ, টু
স্ট্রোকবিশিষ্ট ইঞ্জিন বন্ধ,
বিষাক্ত রাসায়নিক সার বা দ্রব্য
আমদানি বন্ধ করতে মানুষ সাফল্য পেয়েছে। তাই বিশ্বায়নের আগ্রাসী ভাব রুখতে হলে সম্মিলিত সামাজিক শক্তির কোনো
বিকল্প নেই। প্রযুক্তি ব্যবহারের
নীতিমালা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
গ্রহণ না করায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ
আরো কার্যকরভাবে থাকা জরুরি। নতুন করে ভাবতে হবে। যুদ্ধের সময় যখন পশ্চিমা দেশসহ প্রায় সারা বিশ্বের মানুষ ও
প্রচারমাধ্যম পাশে এসে দাঁড়ায়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে যখন 'অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল' কথা বলে_সেখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি ততটা অনুপ্রেরণা দেয় না, যতটা দেয় মানবিকতাবোধ।
এসব ভূমিকাও বিশ্বায়নের সংজ্ঞায় পড়ে। তাই পৃথিবী ও সমাজকে ঝুঁকিমুক্ত করে বাসযোগ্য করার জন্য প্রয়োজন বর্তমান বিশ্বের
গতি-প্রকৃতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা।
লেখক : পরিবেশকর্মী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন