Powered By Blogger

সোমবার, ৮ জুন, ২০১৫

পরিবেশ দিবস ২০১৫

‘শত কোটি জনের অপার স্বপ্ন, একটি বিশ্ব, করি না নিঃস্ব’




গত ৫ জুন পালিত হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস।এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য শত কোটি জনের অপার স্বপ্ন, একটি বিশ্ব, করি না নিঃস্ব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও বাণী দিয়েছেন।

পরিবেশ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশের সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, এজন্য জন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বোধ যেমন জাগিয়ে তুলতে হবে, তেমনি আইনের পরিপালনও নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে সরকারের পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়সহ সকল মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, বর্তমানে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য এ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণাকে যেমন উত্সাহিত করেছে, তেমনি একটি কর্মকৌশলের আলোকে অভিঘাতের প্রশমন ও অভিযোজনের লক্ষ্যে নিজস্ব অর্থায়নে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ পৃথিবীব্যাপি দূষণবিরোধী উদ্যোগ এবং ক্ষতিপূরণের আন্দোলনেও সোচ্চার ভূমিকা রাখছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, টেকসই উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটানো তবে তা পরিবেশের ক্ষতি করে নয় এবং কোন ভাবেই ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রয়োজনকে পাশ কাটিয়ে নয়।

১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতি বছর ৫ জুন সারা বিশ্বের ১০০ টিরও বেশি দেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়।

জেনে হোক না বুঝে হোক নগর সভ্যতার বিকাশের নামে শিল্প-কলকারখানা গড়তে গিয়ে আমরা মানুষরা প্রতিনিয়ত নষ্ট করছি পরিবেশের ভারসাম্য। এভাবে চলতে থাকলে মানবসভ্যতা শুধু বিপন্ন নয়, হারিয়ে যাওয়ার আশংকাও অমূলক নয়। এই কথা মাথায় রেখেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গণ-সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সম্মিলিত কার্যকর বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম বড় আকারের আয়োজন হয় ১৯৭২ সালে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিবেশ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছরের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসপালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ১৯৭৩ সালে।
জাতিসংঘ পরিবেশ প্রোগ্রাম ( ইউএনইপি) প্রতি বছর ৫ জুন সংস্থার সদস্য দেশগুলোতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে থাকে। United Nations Environment Programme ( ইউনাইটেড ন্যাশনস ইনভারনমেন্ট  প্রোগ্রাম)  এর শ্লোগান হলো environment  for  development ( উন্নয়নের জন্য পরিবেশ)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রতি বছর পরিবেশ দিবসে একটিকে সামনে রেখে নতুন নতুন প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়। সংস্থার ওয়েব সাইটে (http://www.unep.org/wed/2015_slogan/) দেখা যায় ২০১৫ লিখে তার নীচে লেখা: টাইম ফর গ্লোবাল এ্যাকশন ফর পিপল এন্ড প্ল্যানেট। প্রতিপাদ্য: Seven Billion Dreams.One Planet./ Consume with Care. অর্থাৎ  ৭শকোটি মানুষের স্বপ্ন একটাই পৃথিবী , ত্নের সাথে ভোগ করি, ওপর ভোট নেয়া হচ্ছে।ইউএনইপির বাংলাদেশ চেপ্টার এর বাংলা করেছে,‌শত কোটি জনের অপার স্বপ্ন, একটি বিশ্ব, করি না নিঃস্ব অনেকে এই শ্লোগানকে এর সংক্ষেপ করে বলছেন, sustainable lifestyles. অর্থাৎ টিকসই জীবনধারা। অর্থাৎ আসুন,দীর্ঘ দিন টিকে বা বেঁচে থাকার মতো করে পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করি।

পরিবেশের সাথে মানবসভ্যতার সম্পর্ক কতটা নিবিড় তা ফুটে উঠেছে আজ থেকে ১শ৬০ বছর আগে আমেরিকার ১৪তম প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন পিয়ার্সের কাছে আমেরিকার এক নাম না জানা রেড ইন্ডিয়ান সরদারের লেখা একটি চিঠিতে।  ১৮৫৪ সালে, অ্যামেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সিয়াটলে বসবাসরত রেড ইন্ডিয়ানদের নির্দেশ দেন  তার যেন তাদের নিজেদের বসতি (সিয়াটল) ছেড়ে চলে যায়। কারণ সেখানে একটি আধুনিক সভ্য শহর গড়ে তোলা হবে। তখন সিয়াটলের সেই রেড ইন্ডিয়ান সর্দার আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে আবেগময়ী ভাষায় যে চিঠিটি লিখেছিলেন সেখানে সরদার নিজেকে লাল মানুষ আর আমেরিকানদের শাদা মানুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর শিরোনাম ছিলো: ওয়াশিংটনের বড় সাদা সরদারের কাছে সিয়াটল উপজাতির প্রধানের চিঠি। পরিবেশবাদী লেখক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার তাঁর এক লেখায় চিঠিটির যে বাংলা অনুবাদ তুলে ধরেছেন তা হলো:
কী  করে তোমরা বেচাকেনা করবে আকাশ, ধরিত্রীর উষ্ণতা? আমরা তোমাদের চিন্তা বুঝতে পারিনা। বাতাসের সতেজতা, জলের ঝিকমিক  আমরা তো এগুলোর মালিক নই, তবে তোমরা আমাদের থেকে এগুলো কিনবে কী করে? এই ধরিত্রীর প্রতিটি অংশই আমাদের লোকদের কাছে পবিত্র। পাইন গাছের প্রত্যেকটি চকচকে ডগা, বালুকাময় প্রতিটি সমুদ্রতট, অন্ধকার বনভূমিতে জমে থাকা কুয়াশা, প্রতিটি প্রান্তর, পতঙ্গের গুনগুন আমার লোকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিতে পবিত্র। প্রতিটা বৃক্ষের ভিতর দিয়ে যে বৃক্ষরস প্রবাহিত হচ্ছে তারা লাল মানুষদের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে। শাদা মানুষদের মৃতেরা তাদের নিজেদের দেশকে ভুলে দূর আকাশের তারার কাছে স্বর্গে চলে যায়, আমাদের মৃতেরা এই সুন্দর পৃথিবীকে কখনও ভোলেনা, কেননা এই পৃথিবী লাল মানুষদের মা। আমরা এই ধরিত্রীর অংশ, এও আমাদের অংশ। সুগন্ধ ফুলগুলো আমাদের বোন, হরিণ ঘোড়া বিশাল ঈগল পাখি  এরা সবাই আমাদের ভাই। পাহাড়ের পাথুরে সব গহবর, সরস মাঠ, ঘোড়ার বাচ্চার গায়ের যে-উষ্ণতা আর মানুষ সবকিছু মিলে আমাদের একই পরিবার। তোমরা আমাদের বল যে তোমরা আমাদের  দেশ নিবে আর বিনিময়ে আমাদের বাস করার জন্যে একটা রিজার্ভ অঞ্চল দেবে যেখানে আমরা আরামে থাকব। আমরা তোমাদের কথা বিবেচনা করে দেখব। কিন্তু এটা এত সহজ নয়। এই ভূমি আমাদের কাছে পবিত্র। যদি আমরা এই ভূমি তোমাদের দিয়ে দিই তাহলে তোমাদের মনে রাখতে হবে যে এই ভূমি পবিত্র। তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদেরও নিশ্চয় করে শেখাবে এর পবিত্রতার কথা। তাদের শিখিও যে এখানকার হ্রদগুলোর পরিষ্কার জলের মধ্যে দেখতে পাওয়া যে কোন রহস্যময় ছায়াই আমাদের মানুষদের জীবনের কোন না কোন ঘটনার স্মৃতি। ঝরণাগুলোর জলের মর্মরে আমার বাবার ও তার পিতৃপুরুষদের স্বর শোনা যায়।
নদীরা আমাদের ভাই, তারা আমাদের তৃষ্ণা মেটায়। নদীরা আমাদের ক্যানো (নৌকা) বয়ে নিয়ে যায়, আমাদের ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার যোগায়। যদি আমরা আমাদের দেশ তোমাদের দিই তাহলে তোমরা মনে রেখো, তোমাদের ছেলেমেয়েদের শিখিও  যে নদীরা মানুষের ভাই সুতরাং তোমরা নদীদের সে রকমই যতœ করো, যেমন তোমরা তোমাদের ভাইদের করো। আমরা জানি শাদা মানুষেরা আমাদের ধরণধারণ বোঝে না। তার কাছে পৃথিবীর এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের কোন তফাৎ নেই। কেননা সে ভিনদেশী রাত্রির অন্ধকারে আসে, নিজের যা দরকার মাটির কাছ থেকে  কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যায়। এই ধরিত্রী তার আত্মীয় নয়, তার শত্রু। সে একে জয় করে, তারপর ফেলে দিয়ে যায়। সে পিছনে ফেলে দিয়ে যায় তার নিজের পিতার কবর, কিছুই মনে করে না। নিজের সন্তানদের কাছ থেকে পৃথিবীকে সে চুরি করে, কিছুই তার মনে হয়না। শাদা মানুষদের শহরে কোথাও শান্ত নিরিবিলি জায়গা নেই যেখানে বসে বসন্তকালে পাতার কুঁড়িগুলোর খুলে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। অবশ্য হয়তো আমরা জংলী বলেই আমাদের এ রকম মনে হয়। জীবনের কী মূল্য আছে একজন লোক যদি জলের ঘূর্ণির মধ্যে আপন মনে একাকী গুনগুন করার শব্দ শুনতে না পায়? আমি একটা লাল মানুষ, আমি তোমাদের শহরের কিছু বুঝতে পারি না।
আমরা, লাল লোকেরা ছোট পুকুরের জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের হালকা শব্দ শুনতে ভালোবাসি, ভালোবাসি দুপুরের বৃষ্টিতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া বাতাসের নিজস্ব গন্ধ, পাইন বনের গন্ধ। আমরা তোমাদের দিয়ে যাব আমাদের জমি, আমাদের বাতাস। মনে রেখো, এই বাতাস, এই জমি আমাদের কাছে মূল্যবান, কেননা জন্তু গাছ মানুষ সবার নিশ্বাস এই একই বাতাসের মধ্যে ধরা আছে। যে বাতাস আমাদের পূর্ব-পুরুষের বুকে তার প্রথম বাতাসটি দিয়েছিল, সেই তার শেষ নিঃশ্বাসটিকে ধরে রেখেছে। তোমরা তোমাদের সন্তানদের শিখিও যে তাদের পায়ের তলায় যে মাটি, তাতে আছে তাদের পিতৃপুরুষের দেহাবশেষ, তাই মাটিকে যেন তারা শ্রদ্ধা করে। তোমাদের সন্তানকে শিখিও এই মাটিতে আছে তাদের পূর্বজদের ছাই। আমাদের স্বজনদের প্রাণ মাটিতে মিশে একে সমৃদ্ধ করেছে। একথা আমরা জানি যে পৃথিবী মানুষের সম্পত্তি। মানুষই পৃথিবীর। আমরা একথা জানি। প্রতিটি জিনিসই একে অন্যের সাথে বাঁধা যেমন রক্তের সম্পর্কে একটা পরিবারের লোকদের বেঁধে রাখে। সবকিছুই একে অন্যের সাথে বাঁধা। এই পৃথিবীর যা হবে পৃথিবীর সন্তানদেরও তাই হবে। জীবনের এই ছড়ানো জাল, মানুষ একে  বোনেনি সে কেবল একটা সুতো মাত্র। এই জালটিকে সে যা করবে তার নিজেরও হবে ঠিক তাই। এমনকি শাদা লোকেরা, যাদের ঈশ্বর বন্ধুর মত তাদের সাথে চলাফেরা করেন, কথা বলেন, তারাও সকলে এই সাধারণ নিয়তির বাইরে নয়। শেষ অবধি হয়ত দেখা যাবে যে আমরা সকলেই একে অন্যের ভাই। যে কথা আমি জানি, হয়ত একদিন সে কথা শাদারা বুঝতে পারবে যে আমাদের ঈশ্বর আসলে একই।
সিয়াটলের রেড ইন্ডিয়ান সরদার এক শতাব্দী আগে পরিবেশের সাথে মানব সভ্যতার যে সম্পর্ক উপলদ্ধি করেছিলেন আজকের এই বস্তুবাদী সভ্যতাগর্বী আধুনিক মানুষরা কি তা উপলদ্ধি করতে পারছে? অবশ্যই পারছিনা। যদি পারত তাহলে আমাদের বুড়িগঙ্গা নর্দমায় পরিণত হতো না, শীতালক্ষ্যা হতো না কেমিক্যালের বিষে নীল, তুরাগ আর বালু নদীর বুকে গড়ে উঠতো না আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা। তিতাস হতো না একটি মরা নদীর নাম, আন্তর্জাাতিক সম্পত্তি গঙ্গা,ব্রহ্মপুত্রের উজানে ৫৪ টি বাঁধ দিয়ে কোন আগ্রাসি শক্তি মানুষ আর জীববৈচিত্র্যের ঘাতকে পরিণত হতো না। নৌপথ বানিয়ে নষ্ট করা হতো তা বিশ্ব জীবনবৈচিত্র্যের মূল্যবান সম্পদ সুন্দরবন। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে নিজের লাভটাকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে আগ্রাসি জীবনযাপন করলে পরিবেশ বাঁচবে না। পরিবেশ না বাঁচলে পৃথিবী টিকবে না। পৃথিবী না থাকলে আমরা কেউ বাঁচবো। আমাদের আগামী প্রজন্ম হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে মানবসভ্যতা। আর এজন্যই আমাদের সবার দায়িত্ব  পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করে মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা। লেখক: মো: হারুন অর রশীদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন