সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
একদিকে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যার ভয়াবহ বৃদ্ধি, অন্যদিকে ঘরবাড়ি বৃদ্ধি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। বাড়ছে নানা ধরনের দূষণ। আর সবকিছুর মাঝখান থেকে সংকটকে পুঁজি করে কেবল ব্যবসা করে যাচ্ছে কিছু মানুষ। অথচ পরিবেশ ও এর প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতা মাথায় রেখেও সেটা করা যায়। বিল্ডিং আর উন্নয়ন তো সমার্থক নয়। আগামী তিন বছর পর ঢাকায় পানি সংকট দেখা দেবে তীব্রভাবে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। ঢাকার আশপাশের যেসব নদী আছে তার পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করার উপায় নেই। আমাদের অপরিকল্পিত অতীত আর স্বেচ্ছাচারী বর্তমানকে উপেক্ষা করে অনেক আশাবাদই হয়তো ব্যক্ত করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে, আমরা এখনও আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আছি। এ সংকট নিরসনের নির্ভরযোগ্য বা সুপরিকল্পিত কোনো জরুরি পদক্ষেপও এ পর্যন্ত আমাদের নজরে আসেনি।
একদিকে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যার ভয়াবহ বৃদ্ধি, অন্যদিকে ঘরবাড়ি বৃদ্ধি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। বাড়ছে নানা ধরনের দূষণ। আর সবকিছুর মাঝখান থেকে সংকটকে পুঁজি করে কেবল ব্যবসা করে যাচ্ছে কিছু মানুষ। অথচ পরিবেশ ও এর প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতা মাথায় রেখেও সেটা করা যায়। বিল্ডিং আর উন্নয়ন তো সমার্থক নয়। আগামী তিন বছর পর ঢাকায় পানি সংকট দেখা দেবে তীব্রভাবে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। ঢাকার আশপাশের যেসব নদী আছে তার পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করার উপায় নেই। আমাদের অপরিকল্পিত অতীত আর স্বেচ্ছাচারী বর্তমানকে উপেক্ষা করে অনেক আশাবাদই হয়তো ব্যক্ত করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে, আমরা এখনও আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আছি। এ সংকট নিরসনের নির্ভরযোগ্য বা সুপরিকল্পিত কোনো জরুরি পদক্ষেপও এ পর্যন্ত আমাদের নজরে আসেনি।
গোটা দেশটাই এখন কিছু গোষ্ঠীর হাতে
জিম্মি। বর্তমানে ঢাকা শহরে আবাসনের
নামে কী হচ্ছে? জলাশয়
ভরাট করেও আবাসন হচ্ছে। এখানে যেসব ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে তার
বেনিফিশিয়ারি কারা? বেসরকারি তিন-চারটি আবাসন কোম্পানি। মূলত উচ্চবিত্ত, বড়জোর উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য এসব
ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। ঢাকা
শহরে এমন কোনো উচ্চবিত্ত বা উচ্চ
মধ্যবিত্তের কথা শুনিনি যার ফ্ল্যাট নেই
বলে তিনি রাস্তায় থাকছেন। বরং দরিদ্ররা
পথে পথে জীবন কাটাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত
বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ঢাকায় থাকতে না
পারলে পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে
দিচ্ছেন। তাদের জন্য তো কোনো আবাসন
ব্যবস্থা হচ্ছে না। তার মানে, এখানে সম্পদের সুষম বণ্টন
হচ্ছে না। এটা পরিবেশ ন্যায়বিচারের একটা বড় দিক। এই ন্যায়বিচারের মূল
বক্তব্য হলো সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে এবং উন্নয়নটা টেকসই হতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, উন্নয়নকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পরিবেশের ওপর স্থায়ী হচ্ছে দিন দিন। এ ব্যাপারেও সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া আমাদের দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত অন্যান্য পরিবেশ সমস্যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, নদীভাঙন, বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানির আগ্রাসী ব্যবসা পরিচালনা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগই নেই, এ কথা সঠিক না হলেও সরকারের সদিচ্ছা কাজে পরিণত হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও বিরল। পরিবেশ রক্ষায় আইন ও পদ্ধতির প্রণয়ন, সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন হলেও এগুলোর প্রয়োগহীনতা এতই প্রবল যে, আইনগুলো অনেকাংশেই দাঁতহীন ইশতেহারে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে আইনের এ দাঁতকে সবল রাখাই আমাদের কাজ।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পরিবেশের ওপর স্থায়ী হচ্ছে দিন দিন। এ ব্যাপারেও সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া আমাদের দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত অন্যান্য পরিবেশ সমস্যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, নদীভাঙন, বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানির আগ্রাসী ব্যবসা পরিচালনা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগই নেই, এ কথা সঠিক না হলেও সরকারের সদিচ্ছা কাজে পরিণত হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও বিরল। পরিবেশ রক্ষায় আইন ও পদ্ধতির প্রণয়ন, সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন হলেও এগুলোর প্রয়োগহীনতা এতই প্রবল যে, আইনগুলো অনেকাংশেই দাঁতহীন ইশতেহারে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে আইনের এ দাঁতকে সবল রাখাই আমাদের কাজ।
দেশের মানুষের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও মানসিকতার সঙ্গে দেশের পরিবেশেরও গভীর যোগাযোগ রয়েছে। পরিবেশের দূষণকে এখনই ঠেকানো না গেলে সামনের দিনগুলোয় ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বাংলাদেশ মিঠাপানির মাছ উৎপাদনের দিক দিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে তা কমতে থাকবে, যা এরই মধ্যে ভয়ানক হারে কমতে শুরু করেছে। কারণ সমুদ্রের নোনাপানি ভেতরে প্রবেশ করতে থাকবে। আমাদের শস্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে, যা আগেও বলেছি। এখন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার পথে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানব স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। যার প্রভাবও ক্ষতিকর। সর্বোপরি বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসবে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। আর দেশের সার্বভৌমত্ব ও মানবাধিকার রক্ষায় সরকার, ব্যবসায়ী, সাধারণ জনগণ সবাইকেই স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো সহজ পথ নেই। দেশের মানুষের সচেতনতার ওপরও নির্ভর করে পরিবেশের সুরক্ষা।
আর শুধু মানুষ নয়_ প্রাণী হিসেবেও আমাদের প্রধান কাজ নিঃশ্বাস নেওয়া। অন্য কিছু করি বা না করি, নিঃশ্বাস নিতেই হবে। তাই এখানে সম্ভব কিংবা অসম্ভবের কোনো প্রশ্ন নয়_ আমাদের কাঙ্ক্ষিত সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই পরিবেশের গুরুত্ব অনুধাবন করার শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। বাড়িয়ে তুলতে হবে পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের করণীয় সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা। শাসকগোষ্ঠী বা সরকার তো বরাবরই এ ব্যাপারে উদাসীন। তাই শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।
এখন কাউকেই আর এ কথা বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই যে, পরিবেশগত দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি। সামগ্রিক বিশ্বে ধীরে ধীরে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের কৃষি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এ পরিবর্তন। কৃষককে নতুন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। সে জন্য কৃষি খাতকেও আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বাংলাদেশে উন্নয়নের যে ধারা চলছে তা অত্যন্ত পরিবেশবিধ্বংসী। অহরহ দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বন ধ্বংসকারী, পানির অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত নগরায়ন সর্বোপরি এক পরিবেশ বিধ্বংসী সময়ের ভেতর দিয়ে আরও বাজে সময়ের দিকে যাচ্ছি আমরা। এখনই পূর্ণ শক্তি দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে বিবিধ স্বেচ্ছাচারী পরিবেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে নানারকম দূষণ রোধে পর্যাপ্ত আইন থাকলেও প্রয়োগের অক্ষমতায় তা শুধু আইন হিসেবেই পড়ে থাকে। বাংলাদেশের জলাভূমি, বনভূমি ও পাহাড় রক্ষায় পর্যাপ্ত আইন রয়েছে। নদী রক্ষায় তেমন কোনো আইন না থাকলেও যেসব প্রতিষ্ঠানকে নদী রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা যদি প্রত্যয়ী হয় তাহলে দেশের নদীগুলো রক্ষা করা সম্ভব।
কিন্তু আগেই বলেছি এবং আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে, সরকার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যয় ও দায়িত্ব পালনের অভাব প্রকট। কিন্তু ধীরে ধীরে অনেক কিছুই বদলাতে শুরু করেছে। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠছে। নদী ভরাটের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হচ্ছে। পরিমাণে কম হলেও অনেকেই নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসছেন নদী রক্ষায়। মূলত এ সংখ্যা যত বাড়বে পরিবেশ রক্ষার সম্ভাবনা তত বেশি উজ্জ্বল হবে। চাপের মুখে সরকারও অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারের পূর্ণ আন্তরিকতা বোঝা যাবে যদি সরকার আইনি প্রয়োগ এবং স্বস্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। সরকারকে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হলে শেষ ধাপ পর্যন্ত যেতে হবে।
আশার কথা এটাই যে, সরকার দেরিতে হলেও কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে সচেষ্ট হচ্ছে। নতুন নতুন আইনও প্রণয়ন করতে উদ্যোগী হচ্ছে সরকার। কিন্তু পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়নই যে শেষ কথা নয়, তা দেশের প্রধান পরিবেশ সমস্যাগুলোর বর্তমান অবস্থার আলোকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সরকারের দায়িত্ব যেমন পরিবেশ রক্ষায় জনগণকে উৎসাহিত করা_ জনগণেরও উচিত সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে এগিয়ে আসা। আমাদের শত সংকটময় দেশে এ কাজ সরকারের একার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশে প্রায়ই পরিবেশ দূষণের কারণ হিসেবে সাধারণ জনগণের অসচেতনতাকে দায়ী করা হয়। এ ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ আমাদের দেশে পরিবেশ দূষণ যারা করেন বা যাদের প্রত্যক্ষ স্বেচ্ছাচারিতায় পরিবেশ দূষিত হয়_ তারা হলেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। তাদের অজ্ঞ, অসচেতন বলার কোনো কারণ নেই। তাদের সাধারণ জনগোষ্ঠী বলে আলাদা করাও সম্ভব নয়। মূলত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশকে কেমন রেখে যাবেন, এ কথা তারা ভাবছেন না। কারণ তাদের একমাত্র ভাবনা_ কতটুকু লাভ হলো, আরও কত অর্থ উপার্জন করা সম্ভব? তাদের ধনী হওয়ার চিন্তারও কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ৭ হাজার একরের আবাসন ব্যবসার বদলে মাত্র ৫০ একরের কাজ করেই তো বড় লোক হওয়া যায়। কিন্তু তাদের লক্ষ্য তো দেশের আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন। যে উন্নয়নের ভাবনা ভাবতে ভাবতে পরিবেশ বিষয়ক কোনো ভাবনাই তাদের মাথায় থাকে না। থাকার কোনো কারণও নেই। তারা নিজেরা তো ভালো আছেন। নিজেদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন। এ দেশটা শুধুই তাদের ব্যবসা ক্ষেত্র, 'সবার ওপরে ব্যবসা সত্য' ছাড়া তাদের আর কোনো সত্য নেই।
কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সামাজিকভাবে আমাদের একে অপরের সম্পর্কটা যেমন শেয়ারিং এবং কেয়ারিংয়ের মধ্য দিয়ে বজায় থাকে_ পরিবেশের মূল্যবোধটাও তেমন। পরিবেশ থেকে যেমন নেব_ তেমনি পরিবেশকেও আমাদের দেওয়ার আছে অনেক কিছু। সন্তান-সন্ততি এবং নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গেলে পরিবেশের কথা এখনই ভাবতে হবে।
লেখক
পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন