হাসনাইন হাফিজ
প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। দিগন্ত বিস্তৃত বনানী। সবুজের সমারোহ। ফল,
ফুল ও শস্যসমৃদ্ধ মাঠ। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোনো পর্যটককে
বিমোহিত করে। বিশ্ব ঐতিহ্যে বাংলাদেশ 'সৌন্দর্যের রানী' অভিধায় অভিহিত।
এসবই আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত বা দান। তবে মাঝে-মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের
মাধ্যমে এর ব্যত্যয় ঘটে।ইদানীং আমাদের জলবায়ু বেশ সঙ্গীন ও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। অত্যধিক বৃষ্টি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, তুফান, বন্যা, সাইক্লোন, সিডর, আইলা, নারগিস, মহাসেন, মরুকরণ ও খরা-শুষ্কতায় দেশ বিপর্যস্ত প্রায়। রয়েছে সুনামির আশঙ্কাও। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব আমাদের দেশে পড়তে শুরু করেছে। কেননা বাংলাদেশের ভৌগোলিক ভূখ-ের তুলনায় বনভূমি নিতান্তই অপ্রতুল। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ নদী শাসনও অন্যতম কারণ।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ। এ উচ্চতা বৃদ্ধির সমীক্ষা ও মূল্যায়নে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। অবশ্য জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার লক্ষ্যে গঠিত ক্লাইমেট চেঞ্জ নেগোসিয়েশন টিম এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাজুক অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা। অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার_ যা উৎপাদন করছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অঙ্াইড। প্রাকৃতিক পরিবেশের তোয়াক্কা না করে বেধড়ক শিল্পায়ন, প্রয়োজনাতিরিক্ত শিল্পদ্রব্য উৎপাদন, বিজ্ঞানের বল্গাহীন গবেষণা, প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, জিএস ফুড চর্চা, ক্লোনিং_ এসব কিছুর সীমা লঙ্ঘন পৃথিবীর জলবায়ুকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় ও অপব্যবহারের ফলে দূষিত হচ্ছে জলবায়ু, বেড়ে যাচ্ছে ভূকম্পন, উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল, হারিয়ে যাচ্ছে পশুপাখি ও বৃক্ষরাজি। এ অপচয় রোধে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'তোমরা খাও এবং পান করো, তবে অপচয় করো না।' (সূরা আরাফ : ৩১)।
মনে রাখতে হবে, গাছপালা, তরুলতা ও উদ্ভিদ মানুষের খাদ্য সরবরাহ করে। জীবের জন্য অঙ্েিজন প্রদান করে, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখে, ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয় সাধন করে। গাছ ও বৃক্ষরাজি মানবজাতির পরম বন্ধু। গাছপালা বায়ুকে দূষণমুক্ত করে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। এরশাদ হয়েছে, 'আমি আকাশের বৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন তৃণলতা সৃষ্টি করেছি, সবুজ গাছ-গাছালি সৃষ্টি করেছি।' (সূরা আনআম : ১৮)।
প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন অনুসারে পাহাড় ও পর্বতমালা স্থাপন করেন, যাতে পৃথিবীর ভূস্তর শক্তভাবে সবকিছুকে স্বাভাবিক থাকতে সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তিনি পৃথিবীর উপরি ভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।' (সূরা হা-মীম সেজদা : ১০)।
আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দৃশ্যপটে কখনও অনাবৃষ্টি আবার কখনও মুষল ধারে ভারিবর্ষণ। কখনও পানি-শুষ্কতা আবার কখনও প্রলয়ঙ্করী প্লাবন। কোথাও মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতা, কোথাও শৈত্যপ্রবাহ। শীতকালে প্রচ- শীত আর গ্রীষ্মকালে প্রচ- উষ্ণতা মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। অথচ এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এর আগে আমাদের দেশে ছিল না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উৎকর্ষ ছিল পূর্ণ মাত্রায়।
এ বিপর্যয়ের কারণ কী? এ থেকে উত্তরণের পথ কী? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি অযথা কাউকে শাস্তি দিতে চান না। বরং মানুষের ওপর যে বিপদ আসে তা তাদের কৃতকর্মেরই ফলস্বরূপ। মহান আল্লাহ বলেন, 'তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।' (সূরা শুরা : ৩০)।
শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের জিকির তোলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো সম্ভব নয়। এ কথা অনস্বীকার্য, আজকের বাংলাদেশে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসছে তা আমাদের কৃতকর্মেরই ফসল। মানুষ অবাধে অন্যায়, অবিচার, গুম, হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও নানাবিধ অপরাধে নিমজ্জিত। বিস্ময়ের হলেও সত্য, বুজুর্র্গানে দ্বীন, আওলিয়া কেরাম ও হক্কানি ওলামায়ে কেরামের উপর্যুপরি তিরোধানে বাংলাদেশের প্রকৃতিও ভারসাম্যতা হারায়। নেমে আসে নানা সমস্যা, বিপদাপদ ও প্রতিকূলতা। এরশাদ হয়েছে, 'মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। যাতে তিনি তাদের কৃতকর্মের কিছু আস্বাদন করান এবং যাতে তারা ফিরে আসে।' (সূরা রূম : ৪১)।
এ আয়াতটি ক্ষুদ্র হলেও তাতে 'কারণ ও প্রতিকার' উভয়টিই এসেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় পৃথিবীতে একের পর এক বয়ে যাচ্ছে মানুষের কৃতকর্মের কারণেই। মানুষ দ্বীন থেকে দূরে সরে পড়েছে। যার দরুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্ধিত হয়েছে। পাপাচার, নীতিহীনতা, দুর্নীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যভিচার, হত্যা-ধর্ষণ, শিরক-কুফরি দিন দিন বেড়েই চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার আশঙ্কাকে অমূলক মনে করা যায় না।
ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয়ে পৃথিবী ভারাক্রান্ত। ঝড়, সাইক্লোন, খরা-শুষ্কতা, শৈত্যপ্রবাহ এরই পরিণাম। উলি্লখিত আয়াতে সূক্ষ্মভাবে এ কথাটি এসেছে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, 'যাতে তারা ফিরে আসে'। অর্থাৎ মানুষ যে গোমরাহির সমুদ্রে ডুবন্ত তা থেকে প্রত্যাবর্তন করার জন্যই এতসব বিপদাপদের পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। যতদিন মুসলিম সমাজ নৈতিকতার সীমারেখা অতিক্রম করবে এবং পাপাচারের পথে থাকবে, ততদিন আমাদের ওপর দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে যেতে পারে। এ চিরসত্য অস্বীকার করে কখনওই দুর্যোগমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।
মানুষের পাপাচার প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের অন্যতম কারণ। এতে গবাদিপশুসহ অন্যান্য সৃষ্ট জীব সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণ ও নিষ্কৃতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা, সত্যের পথে অনুগমন ও পাপ বর্জন করার বিকল্প নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন