আলতাব হোসেন
ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে সরকার। ফান্ডে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। শুরু থেকে জলবায়ু তহবিলের প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। সাত বছর আগে নেওয়া ২১৭ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলেও কোনো কোনো প্রকল্প থেকে বরাদ্দের পুরো অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ১১৭ প্রকল্পের মাধ্যমে তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তহবিলের অর্থায়নে প্রকল্পের অগ্রগতির হারও অত্যন্ত শ্লথ। এ রকম পরিস্থিতিতে ফান্ডটি বিলুপ্ত করতে আসন্ন বাজেটে অর্থ বরাদ্দ না রাখারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
গত ১ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে লেখা এক চিঠিতে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড না রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে আসন্ন বাজেটে জলবায়ু তহবিলে অর্থ বরাদ্দ না রাখার ইঙ্গিত দেন। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জলবায়ু প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষতা অর্জনে এ ফান্ডটি সাময়িকভাবে গঠন করা হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে এ ফান্ডটি বিলুপ্ত হবে। তিনি বলেন, এ ফান্ড পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য একটি নতুন জানালা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, রেজিলিয়ান্স ফান্ডের ব্যবস্থাপনা থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় ওই ফান্ড সরকার পরিচালনা করতে পারবে। একই সঙ্গে দুটি ফান্ড, বিশেষ করে ট্রাস্ট ফান্ড রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, 'কোনোমতেই এই তহবিলকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বা বনায়ন কার্যক্রমের একটি নতুন জানালা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।'
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, বিসিসিটিএফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করে। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক উৎস থেকে পর্যাপ্ত তহবিল প্রাপ্তির সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের নিজস্ব এ ফান্ডের অর্থে ছোট ছোট জরুরি অনেক প্রকল্প ত্বরিত বাস্তবায়ন সম্ভব। এমন একটি ফান্ড থেকে সরকারের সরে আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আসন্ন বাজেটে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডে (বিসিসিটিএফ) নূ্যনতম ২০০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দেরও দাবি জানান তিনি।
গত ২০ এপ্রিল পরিবেশ ও বনমন্ত্রী এবং ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে ফান্ডটি অব্যাহত রাখার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, এই ফান্ড গঠন করে প্রধানমন্ত্রী বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ উদ্যোগটি বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ফান্ড 'গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড' থেকে অর্থ প্রাপ্তির যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে। ট্রাস্ট বিষয়ে হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিলে উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অভিযোজন ও উপশম সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করতে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রিন ফান্ড কার্যকরের আগে এ ফান্ড বন্ধ করা ঠিক হবে না। এ বিষয়ে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ-এর কোঅর্ডিনেটর মিজানুর রহমান বিজয় সমকালকে বলেন, ফান্ড বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে- বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনায় সক্ষম নয়। আর এটি বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রমাণ হলে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে জলবায়ু ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
২০০৯ সালে ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের বছর বাজেটে ৭শ' কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। পর পর তিন বছর বাজেটে ৭শ' কোটি টাকা করে মোট ২ হাজার ১শ' কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এরপর ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ কমিয়ে ৪০০ কোটি টাকা করা হয়। এর পরের বছর থেকে চলতি অর্থবছরে বাজেটে মাত্র ২০০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফান্ডে এ পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯শ' কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৭৭টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ২১৪ কোটি ৯০ লাখ ৩৪ হাজার ৭২১ টাকা। ৬৩টি বেসরকারি সংস্থার নামে ২৫ কোটি ছয় লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এসব বরাদ্দ পেয়েছে। গত সাত বছরে মাত্র ৬৫টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ৮৫টি প্রকল্প ২০০৯ সালের ৩০ জুন শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এসব প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজও হয়নি। অথচ এসব প্রকল্পের প্রায় পুরো টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের কাজে ধীরগতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাস্ট ফান্ডের ৩৫তম সভায় ১২টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি ও ২৩টি প্রকল্পের ব্যয় কমানো হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং জোরদার করায় প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি কিছুটা বেড়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম কমেছে বলেও ট্রাস্ট ফান্ড থেকে দাবি করা হয়েছে। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কুদ্দুস এই ফান্ডে অর্থায়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজের গতি বাড়াতে প্রয়োজনে মনিটরিং জোরদার ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নতুন আইন প্রবর্তন করা যেতে পারে।
২০০৯ সালে সরকারি অর্থায়নে বিসিসিটিএফ গঠনের সময় বলা হয়েছিল, সরকারের নিয়মিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনুমোদন, অর্থছাড় ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন একটি জরুরি বিষয়, তাই দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার জন্য ১০ জন মন্ত্রীসহ ১৫ সদস্যের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। অর্থ ছাড়ের দায়িত্ব থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকার ৩৭টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় আট হাজার কোটি টাকা জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ব্যয় করে। এসব প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বাস্তবায়িত হয়। এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গত তিন বছরে মোট তিনটি স্বতন্ত্র তহবিল গঠন করা হয়েছে। পাঁচ হাজার কোটি টাকার এসব তহবিলের আওতায় এমন সব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, যা এডিপির মধ্যেই রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের বাংলাদেশে জলবাযু পরিবর্তনে সরকারি ব্যয় নামের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ফলে সব মিলিয়ে সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজ সমন্বয়হীন এবং জোড়াতালি দিয়েই চলছে। পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রগুলো বলছে, জলবায়ু তহবিলগুলোর মাধ্যমে ব্যয় করা অর্থের বড় অংশই ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও সমন্বয়হীনতার কারণে মূল সুবিধাভোগীদের কাছে পেঁৗছাচ্ছে না।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, জলবায়ু বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দৃষ্টি হাজার কোটি ডলারের দিকে থাকা উচিত। বৈশ্বিক অর্থায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে অর্থ আনার চেষ্টা করতে হবে। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, বাংলাদেশ জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা রাখে। আগামীতে বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকে দুইভাবে অর্থায়ন হবে- যেসব দেশের সক্ষমতা আছে তারা সরাসরি অর্থ পাবে। আর যারা সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারবে না, তারা এডিবি বা ইউএনডিপির মাধ্যমে অর্থ পাবে। অর্থ মন্ত্রণালয় ইআরডির মাধ্যমে তহবিল আনার চেষ্টা করছে। তবে দেশের কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ কাজের জন্য যোগ্য সেটা ইআরডি চিহ্নিত করতে পারছে না। তারা বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজের জন্য টেন্ডার দিচ্ছে। এতে পুরো প্রক্রিয়াটি একটি জটিল অবস্থার দিকে যাচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সূত্র: সমকাল
A nice Article
উত্তরমুছুন