Powered By Blogger

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০১৫

বিপণ্ন পরিবেশ



এসএইচএম গোলাম সরওয়ার

পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে বিপন্ন প্রকৃতি

 

উদ্ভিদ, প্রাণী, অনুজীব, মাটি, পানি, আলো, বাতাস ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে পরিবেশ। প্রতিটি উপাদানই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক কারণে এ উপাদানগুলোর মধ্যে যে কোনো একটির পরিবর্তন ঘটলে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। কার্বন-ডাই অক্সাইড, সিএফসি গ্যাস, মিথেন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, রাসায়নিক পদার্থ ধোঁয়া, ধূলিকণা, ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি পরিবেশকে দূষিত করে। ভৌতিক, রাসায়নিক, জৈবিক ও মানবসৃষ্ট কারণে পরিবেশ দূষণকারী পদার্থ অধিক হারে বৃদ্ধির জন্য পরিবেশ দূষিত হয় এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এই ভারসাম্যহীন পরিবেশের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। আর এ কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দীর্ঘ সময় খরা, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অসময়ে বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিধস, শৈত্য প্রবাহ ও ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হয়। পরিবেশ দূষিত হওয়ার কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, শিল্পাঞ্চল, পাহাড়-বনাঞ্চল ও নদ-নদীগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার কারণে বাঁধ, বেড়িবাঁধ ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য অবকাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে ফসলের জমিতে লবণ পানি প্রবেশের মাধ্যমে কৃষি জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মাটি দূষিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত মাটিতে চাষযোগ্য লবণসহিঞ্চু ফসলের জাত কম থাকার কারণে শস্য উৎপাদনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে আমন ধান চাষ করা সম্ভব হলেও বাকি মৌসুমগুলোতে হাজার হাজার হেক্টর জমি, যেমন- রবি মৌসুমে ৩৫ ভাগ, খরিফ-১ মৌসুমে ৫৭ ভাগ ও খরিফ-২ মৌসুমে ৭ ভাগ ফসলি জমি লবণাক্ততার কারণে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততা উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। অপরদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না বললেই চলে। এ অঞ্চলে স্বল্প বৃষ্টিপাত, খরা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মাটি শুকিয়ে শক্ত ও কঠিন আকার ধারণ করছে। এ কারণে মাটির অভ্যন্তরের অনুজীবের কার্যাবলী লোপ পেয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে মাটি শক্ত ও কঠিন হওয়ার কারণে ফসল চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রয়োজন হচ্ছে। সেচকার্যে অধিক পানি ব্যবহারের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং পানির মজুত ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিল্পাঞ্চলে শিল্প-কারখানার বর্জ্য, ট্যানারি বর্জ্য, এসিড ও নানা ধরনের ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ খাল ও নদীর পানির সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে আশপাশের ফসলি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে মাটিকে দূষিত করছে। এসব ময়লা-আর্বজনা, বর্জ্য ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নর্দমা, খাল, বিল ও নদীর পানিকেও দূষিত করছে। ফলে বিভিন্ন জাতের ফসল ও মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী বিষাক্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে পানি ব্যবহারের অনোপযোগী হয়ে পড়ছে। পাহাড় ও বনাঞ্চলের গাছ কাটার ফলে পাহাড়ের নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দেশের অধিকাংশ নদ-নদী উৎপত্তি স্থল থেকে সৃষ্টি পর ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত তাদের অংশে এসব নদীর ওপর বাঁধ, ব্যারেজ, স্লুুইস গেট, খালসহ কৃত্রিম নদী খননের মাধ্যমে পানির গতি পরিবর্তন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে অজস্র পানি ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশের অংশের নদীতে পানি থাকছে না। যার ফলে অধিকাংশ নদী তার নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। পদ্মা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ আরও ছোট-বড় অনেক নদ-নদী এ শুষ্ক মৌসুমে বালুর মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। নদীতে পানি নেই, চারদিকে শুধু হাহাকার। এ কারণে পানির মজুত ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে ও কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজপ্রাণী ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে।
জীববৈচিত্র্য টিকে থাকা ও ফসলের উৎপাদন নির্ভর করে মাটি, পানি/বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বাতাস, তাপমাত্রা ও আলোর প্রখরতার ওপর। এ উপাদানগুলোর মধ্যে যে কোনো একটির অভাব দেখা দিলে সামগ্রিক কৃষি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সচরাচর দেখা যায় অসময়ে বা আগাম বন্যার কারণে বোরো ধানসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বন্যার স্থায়ীত্বকাল দীর্ঘ হওয়ার কারণে আমন ধানসহ আগাম রবিশস্য চাষে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। অসময়ে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং লাগাতার বৃষ্টিপাতের কারণে নানা জাতের ফসল কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানো সম্ভব হচ্ছে না।
ঝড়, টর্নেডো ও শিলা বৃষ্টির কারণে মাঠের ফসল ধ্বংস হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, তরমুজ, টমেটো প্রভৃতি ফসলের ফুল ঝরে যাচ্ছে এবং শাকসবজি, আলু, সরিষা, পানের বরজ, বোরো ধানের চারাসহ বিভিন্ন প্রকার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে। নারিকেল, সুপারি ও কলাগাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে ছোট ছোট গাছগুলো মারা যাচ্ছে। মাঠের ফসল বিভিন্ন প্রকার রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এপ্রিল-মে মাসে প্রচণ্ড তাপের কারণে আম এবং লিচুর গুঁটি ঝরে পড়ছে ও খোসা/চামড়া ফেটে পচন ধরে নষ্ট হচ্ছে। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রকার ফসলের উৎপাদন ব্যাহত ও ফলন হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। তাই সমগ্র বিশ্বের মানুষ ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা খুবই জরুরি।
লেখক : কৃষিবিদ, ফার্ম সুপারিনটেনডেন্ট (পিএইচডি ফেলো), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন